আজ সোমবার | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১২:০৬
রিসান রেজা মোঃ সাহেদ:-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানসিক স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ৪ টি বিষয়ে আলোকপাত করে। তাদের তথ্যমতে, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে এমন এক অবস্থাকে বুঝায় যখন-
১. প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে,
২. তার নিজের স্বাভাবিক চাপ মোকাবেলা করতে পারে,
৩. তার কাজগুলো উৎপাদনশীল ও ফলপ্রসূভাবে সম্পাদন করতে পারে এবং
৪. ব্যক্তি তার নিজের বা সম্প্রদায়ের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে
WHO তাদের সংবিধানে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় মানসিক স্বাস্থ্যের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। তাদের মতে, ” Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity.”
আমাদের সমাজের অনেকেই আছি যারা নিজের সম্ভাবনা বুঝতে পারি না। ছোট- বড় বিভিন্ন চাপে ভেঙ্গে পড়ি। সবসময় নিজের কাজগুলো উৎপাদনশীল করে তুলতে পারি না৷ কিন্তু এগুলো নিয়ে ভাবার সময় আমাদের থাকে না। এসকল ক্ষেত্রে আমাদের দুশ্চিন্তা, তীব্র মানসিক চাপ, ঘুমের সমস্যা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, হীনমন্যতাসহ নানারকম জটিলতা তৈরি হয়। একসময় আমরা হতাশ হয়ে পড়ি, বিষণ্ণতা আমাদের গ্রাস করে। ফলাফল তীব্র মানসিক সমস্যা যা শরীরের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
দ্যা ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ (ডাব্লিউএফএমএইচ) এর তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন করে কিশোরী মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছে৷ এছাড়া মানসিক বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। ডাব্লিউএফএমএইচ গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে বুলিং (মানসিক বা শারীরিকভাবে হেনস্তা) এর শিকার হবার ফলে ৮৩ শতাংশ তরুণের জীবনে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। করোনার সময়ে সারা বিশ্বের মানুষের উপর স্ক্রিন টাইম যে প্রভাব ফেলেছে, ট্রলের নামে যেভাবে বুলিং হয়েছে তা বুলিং এর শিকার হওয়া ব্যক্তির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে৷
পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় নগরায়ন, আধুনিকায়নের ছোঁয়ার পাশাপাশি ডিজিটালাইজেশনের যে প্রভাব তার ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি নেতিবাচক কিছু দিক তৈরি হচ্ছে৷ পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের চিন্তা চেতনার। সমস্যার ডাইমেনশনও ঠিক একই ভাবে পরিবর্তন হয়ে চলেছে। ডাব্লিউএফএমএইচ জানাচ্ছে বর্তমান তরুণদের মানসিক জগৎকে খুব বেশি প্রভাবিত করছে সাইবার বুলিং। প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে এ ঘটনাটি এড়ানো যাচ্ছেনা। ইদানিং পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফল না করতে পারা, প্রত্যাশিত চাকুরী না পাওয়া, সঙ্গীর সাথে বিচ্ছেদ ইত্যাদি তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
যে দেশে তারুণ্য যত বেশি, সে দেশের সম্ভাবনা ঠিক ততটাই বেশি। বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বয়স ১৫-২৪ এর ঘরে। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ যারা ২৫-৩৫ এর ঘরে রয়েছে। দেশের অগ্রগতির দায়দায়িত্ব এখন এই সম্প্রদায়ের উপর বর্তাবে। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবা উচিৎ যারা একসময় দেশটার নেতৃত্ব দিবে।
অন্যদিকে বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেকটাই অবহেলিত। একেকজন রেমিটেন্স যোদ্ধা যেন একেকটা মেশিনের মত। তারা বিদেশ যাবে, কাজ করবে আর টাকা পাঠাবে, মেশিনের তেল শেষ হলে আবার ফিরে আসবে। তাদের আবার মনের যত্ন কী! ২০২০ এর মার্চ এর পর থেকে যারা বাংলাদেশে ফিরে এসেছে তাদের নিজ পরিবার, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশি দ্বারা স্টিগমাটাইজ হতে দেখা গিয়েছে। অথচ এই মানুষগুলোর মধ্যে অধিকাংশই দেশ গঠনের জন্য কাজ করেছে। লকডাউনের সময়টাতে তাদের অনেকেরই সাথে নিয়ে আসা টাকা শেষ হয়ে গেলে মধ্যবিত্তের তকমার কারণে তাদের দুর্ভোগের কথা কাউকে বলতেও পারেননি। হীনমন্যতায় ভুগেছেন, অপরাধবোধে ভুগেছেন, দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপে দূর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এগুলোকে গুরুত্ব দেবার সময় হয়নি। নেমে পড়তে হয়েছে নতুন যুদ্ধে। প্রতিবছর বিদেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিকের লাশ তাদের কেউ কেউ দূর্ঘটনার শিকার, কেউ আত্মহত্যা করেন, কেউবা স্ট্রোকে মারা যান। এগুলোর পেছনে কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে তার মানসিক স্বাস্থ্য কোন না কোন দিক থেকে আক্রান্ত ছিল। হয় কাজ না পাওয়া, কাজের অতিরিক্ত চাপ, কর্ম পরিবেশে অন্যান্য জটিলতা, নতুবা পরিবারের সাথে যোগাযোগের জটিলতাসহ নানা মানসিক চাপ তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করছে।
বাংলাদেশে একটা বিষয় বহুল প্রচলিত যে, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সকল সমস্যা শারীরিক কারণ তা দেখা যায়। মানসিক সমস্যা বা বৈকল্য তেমন কোন বালাই নয়, কারণ তা তো আর দেখা যায় না। সমস্যা দানা বাঁধা শুরু হলে এটাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ভেবে মানুষ এটাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় মানুষ যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়, তখন তিনি তার চেয়ে যে ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা উন্নততর তার নিকট বুদ্ধি পরামর্শ আশা করেন। মৃদু মানসিক সমস্যাকে আমলে না নিয়ে কারো কাছে জানাতে দ্বিধাগ্রস্থ থাকে এই ভয়ে যে, মানুষ তাকে মানসিক রুগী ভাববে। ফলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে যা কখনই কাম্য নয়। ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা, খিটখিটে মেজাজ, মৃদু মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, হতাশা এসব থেকে এক সময় জন্ম নেয় সিজোফ্রেনিয়া, বাই পোলার মুড ডিজঅর্ডার, শূচিবায় (ওসিডি) পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার কনভারসন ডিজঅর্ডারসহ জটিল কিছু মানসিক সমস্যা। বিষণ্ণতায় ভোগে বিশাল সংখ্যক মানুষ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বিষণ্ণতা আর মন খারাপ কে মিলিয়ে ফেলে। তরুণদের মাঝে অনেকেই বিষণ্ণতা কে ফ্যাশন ভাবছে যা সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলালেই দেখা যায়। কিন্তু বিষণ্ণতা এক ধরণের মানসিক বৈকল্য যা কারও মাঝে তৈরি হলে এবং দীর্ঘদিন বিরাজমান থাকলে তাকে মানসিকভাবে পঙ্গুও করে দিতে পারে৷ বিষণ্ণতাকে আত্মহত্যার রাস্তা তৈরি করে দেয়। WHO ধারনা করছে যে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে যে মানসিক সমস্যাটি আর্থ-সামাজিক সংকট তৈরি করবে তার মূলে থাকবে বিষণ্ণতা।
বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশেও ঠিক একইভাবে এই ইস্যুটিকে গুরুত্ব সহাকারে দেখা প্রয়োজন। কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার জন্য যেমন তাদের অভিভাবকদের ভাবতে হবে। ঠিক তেমনি ভাবে ভাল মন্দ নির্ধারণে তাদের সাহায্য করতে হবে। আর তরুণদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়াটা জরুরী। কারণ একসময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন এই তরুণরাই। প্রবীণ এবং নারীদের মানসিক সাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরী। কারণ তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নির্ভরশীল থাকেন। তাই তাদের মানসিক সমস্যাগুলো শোনা বা বোঝাটা খুব জরুরী। WHO এর মতে বিশ্বে বর্তমানে ২৬৪ মিলিয়ন মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে যার মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। এর কারণ অনুসন্ধানে আলোচনা করা যাবে আরেকদিন। আজ শুধু এ বছরের প্রতিপাদ্য টি তুলে ধরে শেষ করতে চাই
Mental Health for All: Greater Investment- Greater Access
সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আগে নিজে সচেতন হই, পরিবারের সদস্যদের সচেতন করি।
ভাল থাকি, ভাল রাখি।
লিখক:রিসান রেজা মোঃ সাহেদ
ইনফরমেশন অফিসার এন্ড কাউন্সেলর,
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম।
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |