- প্রচ্ছদ
-
- রাজধানী
- কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে মামু-ভাগ্নে-শ্যালকের রামরাজত্ব: ১২ কোটি টাকার কেনাকাটায় ১০ কোটি টাকাই আত্মসাত
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে মামু-ভাগ্নে-শ্যালকের রামরাজত্ব: ১২ কোটি টাকার কেনাকাটায় ১০ কোটি টাকাই আত্মসাত
প্রকাশ: ৭ অক্টোবর, ২০২১ ৫:৫৫ অপরাহ্ণ
বিডি দিনকাল ডেস্ক :- কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল। তবে নামে সরকারি হাসপাতাল হলেও বাস্তবে এখানে চলছে রামরাজত্ব। এ রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন খোদ হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দীন। সরকার করোনা চিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে এ হাসপাতালটিকে ঘোষণা করেছে। আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে গত প্রায় দেড় বছর ধরেই তিনি নিজের ভাগ্নে এবং শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে লুটপাটের রামরাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, দুদকসহ বিভিন্ন মহলে লিখিত অভিযোগও গেছে কিন্তু তারপরও সেহাবউদ্দিনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেহাব উদ্দীন শ্যালক জাকারিয়া এবং ভাগ্নে মহিউদ্দিনের মাধ্যমে ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে নিজেই কেনাকাটা করছেন। কোনো কোনোটি ক্রয় দেখাচ্ছেন সাত, আট গুণ, এমনকি দশ গুণ বেশি দামেও। তাও অত্যন্ত নিম্নমানের চিকিৎসা সামগ্রী। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালামাল সরবরাহ না করেই বিল তুলে নিচ্ছেন। গত বছর করোনা শুরুর পর্যায়ে এ রকমের ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৯শ’ টাকার কেনাকাটা করা হয়েছে মেসার্স আলী ট্রেডার্স এবং জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এই দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে। এর একটির মালিক জনৈক আলমগীর। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির প্যাড ব্যবহার করে কার্যাদেশ নিয়েছেন ডা. সেহাবের শ্যালক জাকারিয়া, অপর প্রতিষ্ঠানটি ভাগ্নে মহিউদ্দিনের। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সে যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে সরেজমিনে সেইসব ঠিকানায় এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবাক ব্যাপার হলো ভুয়া, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন দফায় মোট ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৯শ’ টাকার বিল পরিশোধ করা হলেও এর বিপরীতে সরবরাহ নেয়া যন্ত্রপাতির বাজার মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি নয়। অর্থাৎ ১২ কোটি টাকার কেনাকাটায় ১০ কোটি টাকাই আত্মসাত করা হয়েছে।
মেসার্স আলী ট্রেডার্সকে ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ বিল পরিশোধ করা হয় ৮ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ২শ’ ৫০ টাকা, অন্যদিকে একই সময়ে জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে এমএসআর ক্রয় বাবদ বিল পরিশোধ করা হয় ৩ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬৫০ টাকা। কিন্তু জিএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল কোনো এমএসআর সামগ্রী সরবরাহ না করেই পুরো বিল তুলে নেয়। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক ডা. সেহাবের ভাগ্নে মহিউদ্দিন। মেসার্স আলী ট্রেডার্সের মালিক জনৈক আলমগীর। তবে এই প্রতিষ্ঠানের প্যাডে কার্যাদেশ নিয়েছেন ডা. সেহাবের শ্যালক জাকারিয়া। তাকে ৮ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ২শ’ ৫০ টাকার বিল পরিশোধ করা হলেও সরবরাহ নেয়া যন্ত্রপাতির মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি নয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের মার্চে দেশে যখন করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে, শুরুতে সরকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করে। আর এটিকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দীন এভাবে লুটের রাজত্ব কায়েম করেন। জানা গেছে, ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে ডা. সেহাব উদ্দিন নিজেই বিভিন্ন নামে ব্যবসা করছেন। এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন শ্যালক জাকারিয়া ও ভাগ্নে মহিউদ্দিনকে।
শুধু যন্ত্রপাতি বা এমএসআর কেনাকাটায়ই নয়; ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার বিল পরিশোধের নামেও ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক না থাকায় ওই সময় ডা. সেহাব উদ্দিন হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া নিয়ে বিতর্কিত (বর্তমানে কারাগারে) রিজেন্টের সাহেদের সঙ্গে কয়েকগুণ বেশি দামে চুক্তি করেন। অভিযোগ রয়েছে নার্সদের নি¤œমানের খাবার দেয়ারও। যেখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন ডা. সেহাব। আর ডা. সেহাবের এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করায় প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামানকে ওই সময় শাস্তিমূলক বদলি করা হয় বাগেরহাট সিভিল সার্জন অফিসে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৩০ মার্চ, ২০২০ মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানকে ডিপিএম পদ্ধতিতে ১২ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৪১ হাজার ৭৫০ টাকার কার্যপত্র দেয়া হয়েছে। মার্চ মাসেই এভাবে আরও ৩টি কার্যপত্র দেয়া হয়েছে একই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে। ১২ মার্চের কার্যপত্রের মাধ্যমে ৭ ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ১৫ মার্চে ১১ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২ কোটি ৮৩ লাখ ৭ হাজার ৫শ’ টাকা এবং ২৫ মার্চে ৫ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেয় ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন। এসব ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ২৫০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি যন্ত্রপাতিই প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ভুয়া এই প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়ের জন্য দেয়া হয়। ৩০ মার্চে স্বাক্ষর করা কার্যপত্রের ৬ নম্বর তালিকায় পিসিআর মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ। অথচ এ মানের একটি পিসিআর মেশিনের দাম ২৫ লাখ টাকা। যা প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ক্রয়ের জন্য বলা হয়েছে। একই কার্যপত্রের ৪ নম্বরে ডেফ্রিব্লেটর নামে একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৮১ হাজার অথচ এটির দাম সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। ৫ নম্বরে সেন্ট্রাল মাল্টিপারপাস প্যাশেন্ট মনিটর নামে যন্ত্রটির দাম ধরা হয়েছে ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই মেশিনটির সর্বোচ্চ দাম ৮ লাখ টাকা। এদিকে কার্যপত্রে যেসব দেশ ও ব্রান্ডের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ করা হয়নি। চীন থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বিভিন্ন দেশের স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
জিপিও নং-১৯, মহাখালী সি/এ, বনানী ঢাকা নামে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেসার্স আলী ট্রেডার্সের প্যাড ব্যবহার করে ডা. সেহাব উদ্দিনের শ্যালক জাকারিয়া এই কার্যাদেশ নিয়েছেন। যে প্যাডে আলী ট্রেডার্সের মালিক আলমগীরের স্বাক্ষরও নেয়া হয়নি।
ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন এসব অনিয়ম শুধু হাসপাতালের ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি। হাসপাতালের এমএসআর/চিকিৎসা ও শৈল্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয়েও একই চিত্র উঠে এসেছে। ফকিরাপুলের ১২০, হাবিবুল্লাহ ম্যানশনের জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেক নাম সর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬৫০ টাকার কার্যাদেশ দিয়েছেন। এসব সরঞ্জামাদি সরবরাহ না করেই ডা. সেহাব উদ্দিনের ভাগ্নে মহিউদ্দিনের প্রতিষ্ঠান জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এই টাকা উঠিয়ে নিয়েছে।(সূত্র :শীর্ষ নিউজ)
Please follow and like us:
20 20