আজ মঙ্গলবার | ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৭:৩৮
এম, এ কাশেম চট্টগ্রাম ঃ ভালোবাসা জয় করে ক্যান্সারের কাছে হেরে বড় বেদনার এক গল্পের যবনিকা টানলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ফাহমিদা। হাসপাতালের কেবিনে লাল বেনারসি পরে, নাকে অক্সিজেনের নল লাগিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানের মাত্র ১২ দিনের মাথায় পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন তিনি। ফাহমিদা গতকাল ভালোবাসার সেই মানুষটির হাতে হাত রেখে বিদায় নেন।
নিজের হাতের মেহেদীর রঙ মোছার আগে বেনারসির পরিবর্তে সাদা কাফনে মুড়িয়ে হাসপাতাল থেকে বের করা হয় ক্যান্সার আক্রান্ত ফাহমিদার নিথর দেহ। বিয়ের মাত্র ১২ দিনের মাথায় প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মাহমুদুল হাসান। নিশ্চিত পরিণতি এত তাড়াতাড়ি এসে যাওয়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছেন না তিনি। মাহমুদুল-ফাহমিদার ভালোবাসার সংসার না টিকলেও তাদের ভালোবাসার গল্প অনন্তকাল ধরে আলোচিত হবে। নগরীর দক্ষিণ বাকলিয়া চর চাক্তাইয়ে গতকাল বাদ আছর নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে ফাহমিদাকে দাফন করা হয়েছে। ফাহমিদার অকাল মৃত্যুর খবরে গতকাল শোকের ছায়া নেমে আসে।
নগরীর দক্ষিণ বাকলিয়ার চর চাক্তাই এলাকার আবদুস সালাম মাস্টার বাড়ির ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কামাল উদ্দীনের দুই মেয়ে এবং এক ছেলের সংসারে মেজ সন্তান ফাহমিদা। তিনি চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেন। তার বড় বোন সানজানা কামাল স্বামীর সাথে চীনে থাকেন। তবে বোনের শারিরীক অবস্থার অবনতির কারণে গত বেশ কিছুদিন ধরে সানজানা কামাল চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। ছোট ভাই জুনায়েদ কামাল ইন্ডিপেডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ে।
ফাহমিদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচয় হয় কঙবাজারের চকরিয়ার মাহমুদুল হাসানের সাথে। মাহমুদুল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন। পরিচয়ের এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে তৈরি হয় প্রেমের সম্পর্ক। তারা ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে ২০২০ সালের শেষদিকে মাহমুদুলের পরিবারের পক্ষ থেকে ফাহমিদার পরিবারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়। দুই পরিবারের আলাপ আলোচনা বেশ এগুচ্ছিল। কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ফাহমিদার শরীরে রেকটাম ক্যান্সার ধরা পড়ে। আর এতে করে বিয়ের আলোচনার চেয়ে ফাহমিদার চিকিৎসা মূখ্য হয়ে ওঠে। তাকে প্রথমে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা খুব বেশি আশাবাদী না হওয়ায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। সেখানে দীর্ঘদিন তার চিকিৎসা চলে। হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে গিয়ে ফাহমিদার ঘর বাঁধার স্বপ্ন ক্রমে ফিকে হয় যায়। প্রেমিক পুরুষের হাতে হাত রাখার আশা তার দুরাশায় পরিণত হয়। প্রেম, বিয়ে-সংসার কিংবা ভালোবাসা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেও ভুলে যান ফাহমিদা। তার দিন কাটে বাসার বিছানায়, হাসপাতালের কেবিনে। অসহ্য যন্ত্রণার মাঝে বিবর্ণ সকাল-সন্ধ্যা এবং রাতে তার নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠে মুঠো মুঠো ট্যাবলেট, ওষুধ।
ভারতের চিকিৎসকেরা ফাহমিদার চিকিৎসা করে আর লাভ হবে না বলে জানিয়ে দেন। গত ৫ মার্চ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তার শারিরীক অবস্থা বিমানে চড়ার উপযোগী না থাকায় টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে আইসিইউ এম্বুলেন্সে যশোর সীমান্তে এবং সেখান থেকে অপর একটি আইসিইউ এম্বুলেন্সে তাকে চট্টগ্রামে এনে মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালের ৪০৫ নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়। আর তখন থেকে শুরু হয় তার জীবনের কাউন্টডাউন।
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নাকে অঙিজেনের নল লাগিয়ে বিছানায় পড়ে থেকে সময় পার করছিলেন ফাহমিদা। বিবর্ণ সময়। আশাহত জীবনের সুন্দর সময়গুলোর স্মৃতি হাতড়ে দিন-রাত যাচ্ছিল। চরম কষ্টের ওই সময়টাতে একেবারে আলোর ঝলকানির মতো ঘটনার জন্ম দেন মাহমুদুল। ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী প্রেমিকাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন মাহমুদুল হাসান। তিনি নিজের স্ত্রী পরিচয়ে যেন ফাহমিদার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে সেই দাবি জানান পরিবারের কাছে। থাকতে চান ফাহমিদার পাশে, শক্ত করে ধরে রাখতে চান হাত। মাহমুদুলের এই প্রস্তাব অবিশ্বাস্য মনে হয় সবার কাছে। অস্বাভাবিক এই প্রস্তাবে আপত্তি করে ফাহমিদার পরিবার। কিন্তু মাহমুদুলের দৃঢ়তার কাছে সবার আপত্তি উবে যায়।
মাহমুদুল-ফাহমিদার ভালোবাসার কাছে হার মানে চাওয়া পাওয়ার সব হিসেব নিকেশ। গত ৯ মার্চ উভয় পরিবারের সম্মতিতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহমিদার সাথে মাহমুদুলের বিয়ের আসর বসে হাসপাতালের কেবিনেই। ধবধবে সাদা মেডিকেল বেডের উপর লাল বেনারসি পরে বসে আছেন ফাহমিদা, নাকে অঙিজেন নল। গলায় গয়না। বরের গায়ে সোনালী রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি। এক টাকা দেনমোহরে ইসলামী রীতিতে বিয়ে হয় তাদের। দুজন মিলে কাটেন কেক, করেন মালাবদল। উপস্থিত সবাইকে খাওয়ানো হয় খেঁজুর ও মিষ্টি। ভালোবাসার কিংবদন্তী গল্পে রঙিন হয়ে উঠে হাসপাতালের কেবিন। ক্যান্সার হার মানে ভালোবাসার কাছে, সমাজের স্বাভাবিক রীতি নীতিও হেরে যায় মাহমুদুল-ফাহমিদার প্রেমের কাছে।
বিয়ের পর থেকে ঘরে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠে ফাহমিদা। একটু সুস্থ বোধ করলে গত ১৪ মার্চ ফাহমিদাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরদিন ১৫ মার্চ তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তাকে আবারো আনা হয় হাসপাতালে। সেখানে রাখা হয় কেবিনে। গত রোববার অবস্থার অবনতি ঘটলে ফাহমিদাকে স্থানান্তর করা হয় আইসিইউতে। গতকাল ভোর ৫টার দিকে ফাহমিদার অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। খবর দেয়া হয় স্বজনদের। হাসপাতালেই ছিলেন মাহমুদুল হাসান এবং ফাহমিদার ছোটভাই জুনায়েদ কামাল। তারা দুজনেই ছুটে যান আইসিইউতে। সেখানে মাহমুদুল হাসান ফাহমিদার হাতটি ধরে রাখেন। সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে মাহমুদুলের হাতে হাত রেখে জীবনের তরে হাত ছেড়ে দেন ২৬ বছর বয়সী ফাহমিদা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিলাহিৃরাজেউন)। গতকাল বাদ আছর নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়েছে।
ফাহমিদার আত্মীয় সাইফুদ্দিন সাকী দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, একটি কিংবদন্তীর জন্ম দিয়ে হারিয়ে গেলেন ফাহমিদা, বড় বেদনার এই মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে বিয়ে করার বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছে মাহমুদুল। তাদের দুজনের যে ভালোবাসার চিত্র এতে ফুটে উঠেছে সমাজে তার খুব বেশি নজির নেই। কিন্তু বিয়ের মাত্র ১২ দিনের মাথায় ফাহমিদার মৃত্যু সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেল।
Dhaka, Bangladesh মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:17 AM |
Sunrise | 6:38 AM |
Zuhr | 11:58 AM |
Asr | 2:58 PM |
Magrib | 5:18 PM |
Isha | 6:39 PM |