আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ৯:৫৮
আশরাফ উদ দৌলা:-‘রাজনীতি আসলে কোনো খেলা নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ একথা বলে গিয়েছিলেন উইনস্টন চার্চিল। ২০২৩ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সাল বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গঠন করবে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং অনুশীলনগুলিকে পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে। কদাচিৎ বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক জীবন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে তার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। স্বাধীনতা হলো- এমন একটি বিষয় যা ‘গণতন্ত্র’ এর ভিত্তির অন্যতম স্তম্ভ। দুর্ভাগ্যবশত গণতন্ত্রের সেই ধারণাই দেশের মাটিতে উপেক্ষিত। এদেশের গণতন্ত্র বহুবার সামরিক হস্তক্ষেপ, অপব্যবহার, স্বৈরাচারী শাসন ইত্যাদির কারণে ভেঙে পড়েছে যার ফলে নাগরিকের রাজনৈতিক অবস্থান, কণ্ঠস্বর ও অধিকার সংকুচিত হয়েছে। আরও দুঃখের বিষয় হলো, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের জেরে রাজনীতি আজ থিয়েটারে পরিণত হয়েছে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একটি শালীন, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক চর্চার জন্য উত্তরসূরিদের কাছে ঋণী থাকা উচিত। এই জাতীয় চর্চা শুধু জনগণের সমৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (বিআইআইএস)-এর এক সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্কিন কংগ্রেসম্যান বিল রিচার্ডসন বাংলাদেশকে একটি মধ্যপন্থি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে যে ইসলাম এবং গণতন্ত্রের মধ্যে কোন বিরোধ নেই এবং তারা একে অপরের পরিপূরকও’। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের নবজাতক গণতন্ত্রের কাছে স্বীকৃতিস্বরূপ ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, আজকাল বাংলাদেশকে হাইব্রিড শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যা কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘমেয়াদে সরকারে থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার স্থানকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন যা ভবিষ্যতে যে কারোর জন্য পাহাড়প্রমাণ কীর্তির চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। বাংলাদেশকে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের গতিপথে পরিচালিত করার পাশাপাশি এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে, তিনি তার সাহসী ভূমিকার জন্য বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছেন।
তবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্তে কালো মেঘ ঘনাচ্ছে, সম্ভবত একটি প্রবল ঝড় তার গৌরবময় অর্জন তছনছ করে দিতে পারে। অসম্ভব কিছু নেই যা সমাধান করা যায় না। প্রতিটি সমস্যারই সমাধান আছে এবং আমরা বাঙালিরা সহজাতভাবে সৃজনশীল এবং বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমাদের সমস্যা ‘সম্মিলিতভাবে’ সমাধান করতে সক্ষম। বাঙালি বিশ্বের সেই কয়েকটি জাতির মধ্যে যারা একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং বিপুল মানবিক মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে অনেক গর্ব করতে পারে । এই জাতি ১৯৯০, ১৯৯৬ এবং ২০০৯ সালে রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে । তাই, এই ঝড়ও বয়ে যাবে এমন আশা করা হচ্ছে। যা দরকার তা হলো একটি বিষয় অনুধাবন করা যে- একগুঁয়ে বা হঠকারী হয়ে কিছুই অর্জন করা যাবে না জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে দেশের নেতারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন- আপস না দ্বন্দ্ব? নেতাদের জাতিকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা, বিপরীতে নয়। দুই দলের মধ্যে বিরোধের বড় কারণ হল- বিএনপি এবং তার মিত্ররা সরকারকে একটি বাধ্যতামূলক সময়ের মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকার সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী নির্বাচন সংঘটিত করার ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে। কেউ আপস করার মুডে আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং, এমন কিছু মধ্যম পন্থা কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব যা প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলি একবার ভেবে দেখতে পারে? এখানে কিছু পরামর্শ দেয়া হলো –
১. সংবিধান সংশোধনের কোন প্রয়োজন নেই।
২. মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করার দরকার নেই। তবে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দীর্ঘ ছুটিতে যেতে পারেন। এই সময়ে যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তার কোন নির্বাহী কর্তৃত্ব থাকবে না (মনে রাখতে হবে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করছেন না, শুধুমাত্র ছুটিতে যাচ্ছেন )।
৩. মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু যারা সংসদ সদস্য তাদের সংসদীয় আসন ত্যাগ করার দরকার নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী (একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি) সহ ১১ বা ১৩ সদস্যের মন্ত্রিসভা থাকবে।
৪. মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের ক্ষমতাসীন দল ও তাদের মিত্র এবং বিএনপি ও তার মিত্রদের থেকে সমানভাবে টানা হবে। প্রার্থীদের মনোনয়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট দলগুলো। তবে মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
৫. আইনি ব্যাকআপ দেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করা যেতে পারে, যা ইতিমধ্যেই প্রচলিত রয়েছে।
৬. মন্ত্রিপরিষদের পোর্টফোলিওগুলি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী একাই সিদ্ধান্ত নেবেন, তবে তাকে অবশ্যই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি দেখতে হবে।
৭. বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভেঙে দেওয়া হবে এবং পাঁচজন প্রার্থীর সুপারিশের একটি সেট থেকে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হবে যা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রত্যেককে আলাদাভাবে পেশ করবে। তাদের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিও থাকবে। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর মতো, সিইসি কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব হতে পারেন।
৮. নির্বাচন শেষ হওয়ার এক মাস পর পর্যন্ত শুধু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনই নিশ্চিত করতে নয় বরং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
৯ একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাথে সাথে সংসদ বন্ধ হয়ে যাবে এবং নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হলে বর্তমান সদস্যদের আসন স্বয়ংক্রিয়ভাবে শূন্য হয়ে যাবে।
এর পাশাপাশি বিএনপি ও তার মিত্রদের নির্বাচনে যোগদানের জন্য উৎসাহ প্রদান এবং একটি অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকার নিম্নলিখিত সদিচ্ছামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে:
(১) বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে বিচারাধীন সব মামলা প্রত্যাহার করে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
(২) ফৌজদারি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি ব্যতীত বিরোধী দলের সকল নেতা-কর্মীকে স্থায়ী জামিনে মুক্ত করতে হবে। মামলাগুলি পর্যালোচনা করার জন্য একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে।
৩) অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী যখন ক্ষমতা গ্রহণ করবেন, তখন বেগম জিয়াকে নিরাপত্তা সহ সমস্ত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার মর্যাদা দেওয়া উচিত।
এই ধরনের ব্যবস্থা শুধু ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ভয়ই দূর করবে না বরং বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজি করার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। নতুন সরকারের স্থিতিশীল উত্তরণেও সহায়ক হবে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে বিদ্বেষও দূর হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত গোটা বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একার হাতে। তিনি একাই জাতিকে একটি অপরিবর্তনীয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন। জীবন ও জাতীয় সম্পত্তিকে ধ্বংস হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। এমন অনেক নজির রয়েছে যখন তিনি সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননি। এখন সেই সিদ্ধান্ত নেবার সময় উপস্থিত। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নিজের ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিচক্ষণতা দেখানোর ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞার অভাব নেই। তার দল জয়ী হলে, তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন এবং ইতিহাস তৈরি করে একটি অভূতপূর্ব চার মেয়াদে দেশ শাসনের দায়িত্বভার হাতে তুলে নেবেন। যদি তার দল হেরেও যায় সেটিও একটি সম্মানজনক প্রস্থান হবে। যেভাবেই হোক, তিনি শুধুমাত্র বিজয়ীই হবেন না বরং একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বব্যাপী সম্মানিত হবেন। কেউই তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। কে বলতে পারে নোবেল পুরস্কার কর্তৃপক্ষ তাকে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার এবং দেশে একটি জাতীয় সংকট এড়ানোর জন্য তার অদম্য সাহসের প্রশংসা করে তার হাতে নোবেল শান্তি পুরস্কার তুলে দিতে পারে।
সূত্র : dhakatribune.com
লেখক- আশরাফ উদ দৌলা, সরকারের সাবেক সচিব
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |