উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধিঃ নড়াইল থেকে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও তার দৃষ্টিনন্দন বাসা। এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগাত এবং আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহ দিত। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ক্ষুদ্র প্রজাতির এই পাখি ও তার বাসা আমরা হারাতে বসেছি। দেবহাটা গ্রাম এলাকা সহ দেশের কোথাও বাবুই পাখি ও বাসা দেখা মেলে না। দুই একটি গাছে বাসা থাকলেও তাতে পাখি এখন থাকে না। অথচ আজ থেকে প্রায় ১৪-১৫ বছর আগেও নড়াইল জেলার
গ্রাম-গঞ্জের মাঠ-ঘাটের উঁচু তাল গাছে দেখা যেত বাবুই পাখির বাসা। বোঝা যেত বাবুই পাখির অস্তিত্ব। ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুড়েঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে’ কবি রজনীকান্ত সেনের এই অমর কবিতাটি এখন শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের কবিতা পড়েই এখনকার শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখির শিল্প নিপুণতার কথা জানতে পারে। এখন আর চোখে পড়ে না বাবুই পাখি ও তার তৈরি দৃষ্টিনন্দন সেই ঝুলন্ত বাসা। এক সময় গ্রাম-গঞ্জের তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছে এরা বাসা বেধে থাকতো। তবে তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা বাধা বেশি পছন্দ ছিল। তালগাছ মানেই ছিল বাবুই পাখির বাসা। আগে কোন তালগাছ ছিল না যাতে পাখির বাসা ছিল না।নাড়া পল, তালপাতা, ঝাউ ও কাশ বনের লতাপাতা দিয়ে বাবুই পাখি বেশির ভাগই উঁচু তালগাছে বাসা বাধত। সেই বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা পড়ে যেত না। বাবুই পাখির শক্ত বুননের এ বাসাটি শিল্পের এক অনন্য সৃষ্টি যা টেনেও ছেঁড়া সম্ভব নয়। প্রবীণদের মুখে শোনা যায় নারিকেল, তাল, খেজুর, কাশ ও আখ সহ প্রভৃতির গাছের পাতা এবং লম্বা ঘাস মুখে করে এনে একটি গাছে তিন প্রকারের বাসা নির্মাণ করতো বাবুই পাখি। এর মধ্যে একটি বসবাসের জন্যে একটি ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটানোর জন্যে এবং একটি খাবার সংগ্রহ করে রাখার জন্যে। বাসা নির্মাণের জন্য তারা সাধারণত তালগাছকে বেছে নিতো। কারণ অন্যান্য গাছের ডালপালা ঝড়ে ভাঙার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তালগাছের ডালপালা না থাকায় ভাঙার সম্ভাবনা কম, এক্ষেত্রেও বাবুই পাখির চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এরপর নারিকেল, সুপারি ও খেজুর গাছ। এরা নাড়া পল, ধানের পাতা, তালের কচি পাতা, ঝাউ ও কাশ বন দিয়ে বাসা বাধে। বাসার গঠনও বেশ জটিল, তবে আকৃতি খুব সুন্দর। শুরুতে বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত রাখত। অর্ধেক বাসা বাধার পর তার সঙ্গীকে খুঁজত। স্ত্রী বাবুইটির পছন্দ হলে মাত্র চার দিনে বাসা বাধার কাজ শেষ করে ফেলত। বাসার নীচের দিকে একটি গর্ত বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করে নিত। অন্যটি খোলা রাখত প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য। বাসার ভেতরে-বাইরে কাদা লাগিয়ে রাখত। ফলে প্রবল ঝড়ে বা বাতাসেও টিকে থাকত বাসা। রাতে বাসা আলোকিত করার জন্য জোনাকি পোকা ধরে এনে রাখত। গ্রামের এক কৃষক ওমর আলী বলেন, বাবুই পাখির বাসাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ছোটবেলায় দেখতাম রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলোর মধ্যে অনেক বাবুই পাখির বাসা ছিল। তাদের কিচিরমিচির শব্দে সকালবেলা আমাদের ঘুম ভাঙত। সন্ধ্যা হলে তাদের বাসাই ফেরার দৃশ্য ছিল দেখার মত। কিচিরমিচির শব্দে সন্ধ্যাটা যেন এক অপরুপ মনোরম দৃশ্যে পরিণত হত। কিন্তু আমাদের পুরো এলাকা জুড়ে কোথাও আর বাবুই পাখি সহ তার দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যায় না। বাবুই পাখি ও তার দৃষ্টিনন্দন বাসার বিলুপ্তির পথে একসময় নড়াইল জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে সারি সারি উঁচু তালগাছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেত। এখন তা আর সচরাচর চোখে পড়ে না। তালগাছ দীর্ঘমেয়াদি গাছ। তাই বাণিজ্যিকভাবে তালগাছের আবাদ হয় না। গ্রাম-গঞ্জ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তালগাছ। এর সাথে সাথে বাবুই এখন বাসা বাধারও জায়গা পায় না। তারপর মানুষ জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে গড়ে তুলছে অট্টালিকা। তাছাড়া প্রকৃতি থেকে তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাসা তৈরি করতে পারছে না পাখিরা। আর এই কারণে প্রজননও করতে পারছে না তারা। এখন কৃষকরা ক্ষেতে ও বীজতলায় কীটনাশক ব্যবহার করায় বাবুই পাখি মারা যায়। বংশ রক্ষার্থে তারা এলাকা ত্যাগ করেছে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বাবুই পাখির বংশ বিস্তারে তাল, খেজুর ও নারকেল গাছ রোপণ করতে হবে। সেই সাথে কীটনাশকের অপব্যবহার রোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃতির এই নিপুণ কারিগরকে বাচাতে উদ্যোগ নিতে হবে আমাদেরই।