আজ সোমবার | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১২:৩২
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান :- প্রজাতন্ত্রের দৃঢ়ভিত্তিঃবাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি থাকলেও তার নামেই নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারও বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করেই গঠন (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১) করা হয়েছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকার মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সে শঙ্কা দূরীভূত হয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা ঞযব এঁধৎফরধহ-এ ১০ জানুয়ারি জবপড়মহরুব ইধহমষধফবংয ঘড়ি শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয় : ‘ঙহপব ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ ংঃবঢ়ং ড়ঁঃ ড়ভ উধপপধ অরৎঢ়ড়ৎঃ, ঃযব হবি ৎবঢ়ঁনষরপ নবপড়সবং ধ ংড়ষরফ ভধপঃ’. ১৬ ডিসেম্বর বিকালে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় জায়গা ঢাকার তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী যখন আত্মসমর্পণ করে বন্দিত্ববরণ করেন ঠিক সেই সময়টাতেও নিয়াজীর নিজ শহর মিয়ানওয়ালী সেন্ট্রাল জেলে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সহজে অন্যকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতার বাইরেও শারীরিক গঠন, সুন্দর উচ্চারণে উর্দু বলতে পারা এবং নামের আগে ‘শেখ’ থাকায় মিয়ানওয়ালীর জেলের ডিআইজি শেখ আবদুর রশিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে আটকাপড়া নিয়াজীর শহরে শেখ মুজিবের জন্য নিরাপদ মনে করেননি ডিআইজি শেখ আবদুর রশিদ। শেখ আবদুর রশিদ বঙ্গবন্ধুকে চশমা রেস্ট হাউসে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর কর্নেল আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানি কমান্ডোরা হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে যান সিহালা রেস্ট হাউসে। সেখানেই পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আসেন দেখা করতে।
বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। পিআইএর প্লেন ভারতীয় সীমানার ওপর দিয়ে চলাচলের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে তেহরান পরে সুইজারল্যান্ড, শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাতেই লন্ডনে যাওয়ার বিষয়টি স্থির হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বাইরে কলকাতার পরই লন্ডনে আমাদের সবচেয়ে বেশি সমর্থক ছিল, তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজেও আগে সেখানে গেছেন।
লন্ডনে অবতরণের মাত্র ত্রিশ মিনিট আগে সেখানকার টাওয়ারকে বঙ্গবন্ধুর আগমনের কথা জানান একই প্লেনে আসা পিআইএর চিফ এয়ার ভাইস মার্শাল জাফর চৌধুরী। এয়ারপোর্ট থেকে ব্রিটিশ ফরেন অফিসকে খবরটা জানালে দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের কর্মকর্তা ইয়ান মাদারল্যান্ড এয়ারপোর্টে আসেন। হিথ্রো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বসানো হয়েছিল ‘আলকক অ্যান্ড ব্রাউন’ ভিআইপি স্যুইটে। বঙ্গবন্ধু ইয়ান মাদারল্যান্ডের কাছে বাংলাদেশ মিশন প্রধান আবু সাঈদ চৌধুরীর ফোন নম্বর চান। আবু সাঈদ চৌধুরী ৫ জানুয়ারি ঢাকায় চলে আসেন। মিশনপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন এএমএম রেজাউল করিম। রেজাউল করিমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ফোনে কথা বলেন। এয়ারপোর্টে ছুটে আসেন রেজাউল করিম। তাকে অনুসরণ করে পর পরই এয়ারপোর্টে পৌঁছেন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সেক্রেটারি মহিউদ্দিন ও মহিউদ্দিন জায়গিরদার। এয়ারপোর্টে এসে রেজাউল করিম বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোথায় যাবেন? বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হোটেলের কথা বলেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি লন্ডনে গিয়ে রাসেল স্কয়ারের এই হোটেলটিতেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে মাদারল্যান্ডের বরাত দিয়ে জানানো হয়, ব্রিটিশ সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। যার কারণে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে প্রেসিডেন্ট হোটেলে রাখা যাবে না। এয়ারপোর্ট থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য নির্ধারিত অধিক নিরাপত্তাবেষ্টিত ক্ল্যারিজেস হোটেলে। হিথ্রো থেকে ক্ল্যারিজেস হোটেলে বঙ্গবন্ধুকে নেওয়ার জন্য লিমুজিনের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু পরে বঙ্গবন্ধুর জন্য রেজাউল করিমের ফোর্ড কাটিনা নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ মনে করা হলো। বিমানবন্দরে উপস্থিত মিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিনের গাড়িতে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু ও ড. কামালের স্যুটকেস।
৮ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছেন, সেদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন। তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করে বঙ্গবন্ধুর জন্যই সন্ধ্যায় লন্ডনে ফিরে আসেন। রাতে ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের দুয়ারে যখন বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ি থামলে একটি লোক এসে গাড়ির দরজা খুললেন এবং বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি আর কেউ নন, গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক ঘণ্টার বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে যুক্তরাজ্য কর্তৃক স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের বন্দি অবস্থায় তার জীবন রক্ষার প্রচেষ্টার জন্য বঙ্গবন্ধু এডওয়ার্ড হিথকে ধন্যবাদ জানান। ৯ জানুয়ারি টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধা ঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা যাওয়ার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতির অনুরোধ করলেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে ভারতীয় বিমানের ব্যবস্থা করলেও হিথের পরামর্শে ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের জেটে করেই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সাইপ্রাস ও ওমান হয়ে বিমান দিল্লিতে অবতরণ করলে প্রেসিডেন্ট শ্রী ভরাহগিরি ভেঙ্কটগিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাকে স্বাগত জানান।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিকালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন দিল্লি হয়ে প্রাণের শহর ঢাকা ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। ঢাকায় অবতরণের আগে কমেট বিমানটি বঙ্গবন্ধুর অভিলাষের প্রতি শ্রদ্ধাবশত প্রায় ৪৫ মিনিট বিমানবন্দরের ওপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। ওপর থেকে তার ‘সোনার বাংলা’কে অবলোকন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অভ্যর্থনায় অনেক কূটনীতিক এলেও চীন ও ইরানের কনসাল জেনারেলদ্বয় অনুপস্থিত ছিলেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট ডি. স্পিভাক এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করার সময় সৌজন্য প্রকাশের জন্য সামান্য অবনত হন এবং বলেন, ‘ঢাকায় স্বাগতম’। বঙ্গবন্ধু হেসে উত্তর দেন, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’ বিমানবন্দর থেকে লাখো মানুষের ভিড় ঠেলে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, তার দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বলেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি, বিশ্বকবি তোমার সেই আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণিত করে সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে।’ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার মতো করে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চ থেকে ৩৫ মিনিটের ভাষণে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম, তোমরা আমাকে মারতে চাও মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালিদের কাছে ফিরিয়ে দিও। আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবারই মরে, মরার আগে বলে যাব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম, ‘দুর্গ গড়ে তোলো।’ আজ আবার বলছি, আপনারা একতা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ‘ইনশাআল্লাহ’। বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। আমি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবেÑ পূর্ণ হবে না। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
লেখক ঃঅধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |