আজ সোমবার | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ৪:৩৫
বিডি দিনকাল ডেস্কঃ- ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে মধ্য জুলাইয়ে শুরু হওয়া তীব্র আন্দোলন আগস্টে গিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। যেখানে সারাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, দিনমজুর, ধনী সকল শ্রেণির অংশগ্রহণেই ঘটে ঐতিহাসিক এই গণঅভ্যূত্থান। তবে হঠাৎ করেই ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসেনি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দীর্ঘদিনের অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুন, দুর্নীতি-দুঃশাসনের কারণে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছিল তারই বিস্ফোরণ ঘটেছে জুলাই-আগস্টের বিপ্লবে। আর এই গণঅভ্যূত্থানের পটভূমি তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের ত্যাগের মাধ্যমে। বিশেষত: এক যুগেরও বেশি সময় ধরে হামলা-মামলা, গুম-খুন, অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার বিএনপি নেতাকর্মীদের রক্তেও উপরই।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুরো স্বৈরশাসনামলে বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে গেছে। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করলে বিএনপি দেশজুড়ে জোরদার আন্দোলন শুরু করে, ২০২৪ সাল পর্যন্তই মাঠে ছিল দলটির নেতাকর্মীরা। সেই ২০১১ থেকেই আওয়ামী লীগ নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন থেকৈ ২০২৪ সাল পর্যন্ত এর শিকার হয়েছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ যে ভয়ংকর অত্যাচারী-নিপীড়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তা বিএনপির ওপর অকল্পনীয় অত্যাচার করার মাধ্যমে। এগুলো দেখে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। ২ হাজার ৭০০’র মতো বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে আওয়ামী লীগের এই সময়ে। এর বেশিরভাগই বিএনপি নেতাকর্মী। গুম করার ক্ষেত্রেও প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপিকে করা হয়েছে। রিমান্ডে-কারাগারে নেতাকর্মীদের ভয়াবহ অত্যাচার করা হয়েছে। একের পর এক দেয়া হয়েছে গায়েবি মামলা। নেতাকর্মীদের নামে শত শত মামলা, প্রতিদিন কোর্টে বারাদ্দায় হাজিরা দেয়া, মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব, চাকরি-ব্যবসা সর্বস্ব হারিয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় এসে রিক্সা, উবার চালিয়েছে অনেকে। অনেকের স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছে বিএনপির রাজনীতি করার কারণে, অনেকে এলাকায় যেতে পারেনি দীর্ঘদিন। চারপাশে যখন এসব ঘটেছে তখন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের জালিম সত্ত্বাটা সামনে এসেছে। বিএনপির ওপর নির্যাতনের এসব চিত্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ছড়িয়ে পড়ে। এটির কারণে র্যাবের ওপর ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা আসে, পরবর্তীতে দেয়া হয় ভিসি পলিসি। এর সবই নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে মানুষকে ক্ষুব্ধ করতে। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিয়মিত সকলের সাথে সংযুক্ত থেকে উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যূত্থানে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঢাকায়, ঢাকার বাইরে সর্বত্রই সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন, ধনী-গরিব, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক রাস্তায় নেমেছিলেন। এটি একটি বিরল চিত্র। তবে মূল যুদ্ধটা জুলাইয়ে শুরু হলেও এর পেছনে লম্বা ইতিহাস আছে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যেমন হঠাৎ করে একদিনে শুরু হয়নি। তার পেছনে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০-২২ বছরে বঞ্চনার ইতিহাস ছিল। তেমনি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যূত্থানের পেছনেও দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, আওয়ামী লীগের দানব হয়ে উঠা ভূমিকা রেখেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর এক যুগ ধরে চলা অকল্পনীয় অত্যাচার দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগকে জালিম-নিপীড়ক, নির্যাতক, দানব হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’
বিএনপি নেতারা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করছেন নেতাকর্মীরা। দীর্ঘদিনের এই আন্দোলনে অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছে, গুম হয়েছেন, হামলা-মামলার শিকার হয়েছে প্রায় প্রতিটি নেতাকর্মী। তারপরও তারা হতাশ হননি, ভেঙে পড়েননি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সার্বক্ষণিক সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, দিয়েছেন উৎসাহ-উদ্দীপনা।’
তারা বলেন, ‘বিএনপি বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কখনোই দলের জন্য কোন কিছু চায়নি, আমাদের চাওয়া ছিল দেশকে হাসিনামুক্ত করা, ফ্যাসিবাদ মুক্ত করা, দেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। এককভাবে বিএনপি এটি করতে না পারলেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেটি সম্ভব হয়েছে। যেখানে বিএনপি নেতাকর্মীদের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, হাজারো নোকর্মীকে গুম করে, খুন করে, সাজা দিয়ে, লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে পারেনি সরকার। বরং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ থেকে লড়াই করেছে।
২০০৭ সাল থেকে প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি। ১/১১’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই শুরু হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-নির্যাতন। এ থেকে বাদ যাননি দলের শীর্ষ নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে শুরু করে ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরাও।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গত সাড়ে ১৭ বছরে মামলা হয়েছে প্রায় দেড় লাখ, আসামী করা হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীকে। সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে এবং ক্ষমতাসীনদের হাতে ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫৫১ জন। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে হত্যা হয়েছে ৮৩৭ জন নেতাকর্মী। এই সময়ে ১ হাজার ২০৪ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ গুম হয়েছেন। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত থেকে গ্রেফতার দেখানো হয় ৭৮১ জনকে এবং বিএনপির গুম ছিল ৪২৩ জন। এখনো দলটির ৭২ জন নেতাকর্মী গুম রয়েছেন। যাদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের ১৫৭ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। এই সময়েও সারাদেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
নজীরবিহীন মামলা: সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ মামলা হয়েছে তা নজীরবিহীন। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমনটি ঘটেছে কিনা সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। গত সাড়ে ১৭ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে আসামী প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মী। বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের নেতাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়েছে। ভয়াবহ তথ্য হলো এমনো নেতা রয়েছেন তার বিরুদ্ধে এ সময়ে মামলা হয়েছে ৫ শতাধিক। এছাড়াও কারো নামে ৪০০টি, কারো সাড়ে ৩শ’ কারো নামে ৩০০টি। এমনো নেতা রয়েছেন সপ্তাহের ৫ কার্যদিবসেই সকালে আদালতে হাজির হয়ে দিনভর কয়েকটি মামলায় হাজিরা দিতে হয়েছে। দলটির অনেক নেতা এখনো কারাগারে রয়েছেন। কোনো কোনো নেতাকে এই সাড়ে ১৫ বছরে ৮ থেকে ১০ বার কারাভোগ করতে হয়েছে।
রিমান্ডে-কারাগারে নির্যাতন: আওয়ামী শাসনামলে গ্রেফতার হওয়া একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্যাসিবাদী সরকার পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করতো। গুম হওয়াদের সাথে আয়নাঘরে কি আচরণ করা হতো তা সাম্প্রতিক অনেকেই তা তুলে ধরেছেন। একই রকম আচরণ করা হতো রিমান্ডেও। ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান বলেন, তাকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। তার হাতে-পায়ের সব নখই টেনে তুলে ফেলা হয়। এরকম অসংখ্য নেতাকর্মী অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী বলেন, দলের নেতাকর্মীরা বিগত ১৫-১৬ বছর যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তা দেশবাসীর কাছে দৃশ্যমান। আমরা অনেক নেতাকর্মীকে হারিয়েছি, হামলা-মামলা-নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি কেউ। ২৮ অক্টোবর হয়তো আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়ে যানি। ছাত্ররা যে আন্দোলন শুরু করেছিল তাতে তারা আহ্বান জানিয়েছিল মাঠে নেমে আসার, সমর্থন দেওয়ার। বিএনপি তাদের সেই আন্দোলনে সব সময় সমর্থন ও অংশগ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, এই আন্দোলনের সফলতা এককভাবে কারো ক্রেডিট না, এখানে সকলের অংশগ্রহণ ছিল। যার ফলে ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার টিকে থাকার জন্য যত অপকর্ম আছে তার সবগুলো প্রয়োগ করেছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দিয়ে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে মামলা দেয়া হয়েছে। যদিও এর ৯৯ ভাগ মিথ্যা মামলা। এই মামলা দিয়ে গণবিচ্ছিন্ন সরকার প্রমাণ করেছে এরা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দী করে রেখেছিল। আমাদের নেতা তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্বাসিত করে রেখেছে। আমাদের এমন কোন নেতা নেই যাদের বিরুদ্ধে ৪০-৫০টা মামলা নেই। ৬০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে, ৬শ’র মতো মানুষকে গুম করেছে, সহস্রাধিক হত্যা করেছে। ঘটনা ঘটেনি এমন গায়েবি মামলা দেয়া হয়েছে দেশজুড়ে। দিনের পর দিন নেতাকর্মীদের কারাগারে বন্দী রেখেছে ফ্যাসিবাদী সরকার। এর কারণ ছিল একটাই বিএনপিকে নিঃশেষ করে দেয়া, আন্দোলন দমন করা। কিন্তু তাতে কি তারা আন্দোলন বন্ধ করতে পেরেছে? সফল হয়েছে? জনগণ জেগে উঠেছে, জনগণের উত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |