আজ সোমবার | ২৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৩ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ |১৩ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি | দুপুর ২:৫৬
বিডি দিনকাল ডেস্ক : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বেশ কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছিল। এরপর ক্রমে এ ধরনের কেন্দ্র আরও বেড়েছে। রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল এসব কেন্দ্র স্থাপনের সময় বলা হয়েছিল আপৎকালীন সংকটের সুরাহা করতে এই ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব প্রকল্প হবে স্বল্প সময়ের। স্বল্পমেয়াদি এই রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদেও চলছে।
এক যুগের বেশি সময় ধরে চলা এই ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রই পুরো বিদ্যুৎ খাতের জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসুক বা না আসুক দিতে হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ। গত এক যুগে ভাড়ায় চলা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিতে হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ। সাধারণত প্রতি ইউনিট সাত থেকে আট টাকায় যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় সেই বিদ্যুৎ এসব কেন্দ্র থেকে ১৭ টাকায় কিনতে হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রের বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দাম পড়েছে আরও কয়েকগুণ বেশি।রেন্টাল-কুইক রেন্টালে বাড়তি ব্যয় বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন গ্যাস এবং জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুতের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। দিনে অন্তত ৩ হাজার মেগাওয়াটের ঘাটতি থাকছে। এ কারণে করতে হচ্ছে ঘন ঘন লোডশেডিং। দিনে কোনো কোনো এলাকায় আট থেকে দশ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে শিল্প কারখানার উৎপাদনে ধস নেমেছে। বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।
এমন অবস্থার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর একটি বক্তব্যে হতাশা ছড়িয়েছে সর্বত্র। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক সভায় তিনি পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হবে। তার এই বক্তব্যে উপস্থিত ব্যবসায়ীরাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তারা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান। অসহায় উপদেষ্টা অবশ্য খুব একটা আশার বাণী দিতে পারেননি। সহজে যে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় তা পরিষ্কার হয়েছে তার বক্তব্যে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উপদেষ্টার অনেক দায় আছে। তিনি এমন বক্তব্য দিয়ে মানুষকে আরও হতাশায় ডুবিয়েছেন। সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন পরিস্থিতিকে এতো সংকটপূর্ণ বলে বর্ণনা করেন তখন মানুষ ধরে নিতে বাধ্য হবে যে পরিস্থিতি আর সরকারের নিয়ন্ত্রণের মতো অবস্থায় নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কুইক রেন্টাল ম্যাজিক এখন এই খাতের ভরাডুবির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোববার প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ বিষয়ক উপদেষ্টার দেয়া বক্তব্যে দেশজুড়ে তোলপাড় তৈরি হয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগেই তার বক্তব্য নিয়ে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। উপদেষ্টার বক্তব্য ব্যক্তিগত, দলের নয় বলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী। দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও তার এই বক্তব্যে ভালোভাবে নেননি। বরং তারা বলেছেন, বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য জ্বালানি উপদেষ্টাই দায়ী। তার জন্যই সর্বনাশ হয়েছে এ খাত।
প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্য প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, বিদ্যুতের বর্তমান পরিস্থিতি আরও দুই থেকে তিন মাস থাকতে পারে।
সরকারের অব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি এবং দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের বর্তমানে এই অবস্থা চলছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে নয়। আগের ভুলের কারণে আমরা এখন কষ্ট করছি। তিনি বলেন, দেশে ডলারের ব্যাপক সংকট। এলএনজি আনা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রীই তো আপত্তি তুলেছেন। জ্বালানি উপদেষ্টা বিদ্যুৎ খাত ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম মানবজমিনকে বলেন, সরকার বলছে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা আছে। কিন্তু এখন বলছে বিদ্যুৎ নেই। দিনের বেলায় বিদ্যুৎ দিতে পারবে না। সরকারের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ভোক্তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রসাতলে গিয়েছে দেশ। সঠিকভাবে বিদ্যুৎ খাত উন্নত হলে পয়সা বানানো কঠিন হতো। লুণ্ঠন করে এ খাত থেকে টাকা বানানো হয়েছে। সর্বনাশ করা হয়েছে খাতটিকে। লোডশেডিং হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে আছেন। আর ডিজেল পুড়িয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির লোক। এতে বড় লোকরা সুরক্ষা ঠিকই পাচ্ছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম ওঠানামা করবেই। কিন্তু ডলার পরিশোধ করে আমরা কতটুকু আমদানি করতে পারবো তা সক্ষমতার উপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, দেশে রিজার্ভের সিরিয়াস সমস্যা। ডলারের চড়া মূল্য। এলএনজি কিনতে পারা যাচ্ছে না। শিল্পের জন্য গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু গ্যাস আনা যাচ্ছে না। চার মাস পর চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এসব বিষয়ের কারণে জ্বালানি উপদেষ্টা হয়তো এই বক্তব্য দিয়েছেন। এটা কথার কথা। প্রধানমন্ত্রীও তো দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন। কয়লাভিত্তিক যদি কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসে তখন হয়তো সমস্যা কিছুটা কমে আসতে পারে।
রেন্টাল-কুইক রেন্টালে ডুবেছে বিদ্যুৎ খাত: ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ ১২ বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। সাধারণ খাতে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের খরচ হয় ৭ টাকা। আর ভাড়াভিত্তিক এসব কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ১৭ টাকা। স্বল্প মেয়াদের কথা বলেও এক যুগ ধরে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে বাড়তি দামে। জ্বালানির দাম বাড়ায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লাগাম টানা হয়েছে। এ কারণে বেড়েছে লোডশেডিং। এমন অবস্থায় রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রেখে ব্যয় বাড়ানোকে অযৌক্তিক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁরা বলছেন, স্বল্প মেয়াদে সমাধান হিসেবে রেন্টাল কেন্দ্র চালু হলেও এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো ঠিক হয়নি। এ কারণে বিদ্যুৎ খাতে ঘাটতি বেড়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য এ খাত দায়ী। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারের ব্যয় হয় ১৮ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের পকেটে গেছে ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। ১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মালিক বিদ্যুৎ না বেচেও পান ১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২) বিদ্যুৎ না বেচেও ১২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ৬৭৮ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়। এ প্রক্রিয়ার জন্য ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’। শুরুতে দুই বছরের জন্য এ আইন করা হলেও পরে কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়।
গত বছর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নামে পরিচিত এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ২০২৪ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হবে। সংসদীয় কমিটিকে দেয়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মেয়াদ পূর্তিতে অবসরে যাবে। সংসদীয় কমিটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ আর না বাড়িয়ে দ্রুততম সময়ে সেগুলোকে অবসরে পাঠানোর সুপারিশ করে।
Dhaka, Bangladesh সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:23 AM |
Sunrise | 6:43 AM |
Zuhr | 12:07 PM |
Asr | 3:11 PM |
Magrib | 5:32 PM |
Isha | 6:51 PM |