আজ সোমবার | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৭:০০
বিডি দিনকাল ডেস্ক :- কিন্তু আমার সেই আনন্দানুভূতি ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। তারা বললো, আমার ছবি তোলা হবে এবং ভিডিও ক্যামেরায় তোলা একটা ফুটেজের সামনে আমাকে একটা কাগজে সই দিতে হবে। “কিসের কাগজে?” তারা বললো, “সময় হলেই দেখতে পাবেন।” আমি কিছু বলার আগেই তারা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমার চোখ থেকে খুলে নেওয়া হলো কালো কাপড়ের টুকরো। এবার আমি পুরো ঘরটাকে দেখার সুযোগ পেলাম। এটি অনেকগুলো ঘরের একটি বলে আমার কাছে মনে হলো। ঘরটির ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। চারদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে লোহার রড ও চাকতি, ধাতব চেন, সরু ও মোটা নানা আকারের রশি, নানা ধরনের বৈদ্যুতিক সাজসরঞ্জাম, যার সবগুলোই হলো মানুষের উপর নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করার উপাদান।
এসব সাজসরঞ্জাম এবং ভয়াল কদর্য আচরণ করার জন্য একটা স্বাধীন দেশে এ ধরনের অফিসারদের পেছনে জনগণের অর্থ ব্যয়ের কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
হযরত আলী আমাকে জানালো, “একই উদ্দেশ্যে সেখানে রয়েছে আরো তিনটি কামরা। পাশের কামরায় একটি টিম আরেকজন বন্দির ছবি তোলা ও সই নেওয়ার কাজে ব্যস্ত রয়েছে, সেটা শেষ হলেই তারা এই কামরায় আসবে।” এই বলে সে তাড়াতাড়ি চলে গেল। একটু পরেই রোগা কাঁধে দু’টি ক্যামেরা ঝোলানো অবস্থায় উস্কোখুস্কো একজন লোক এবং প্লাস্টিকের ফাইল হাতে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা আর একজন লোক কামরাতে এসে ঢুকলো। কোনোরকম ওয়ার্নিং না দিয়েই ক্যামেরাম্যানটি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে চারদিক থেকে আমার ছবি তুলতে লাগলো। স্টিল ক্যামেরায় বেশ কয়েকটা ছবি তোলার পর ডিজিটাল ভিডিও ফুটেজও করলো। আরেকজন নির্লিপ্তভাবে ছাপানো কিছু লেখা একটা কাগজের টুকরায় আমার সই নেওয়ার জন্য এনে রাখলো টেবিলের ওপর। কাগজে লেখা ছিল ছোট আকারের একটা বিবৃতি এই বলে যে, বন্দি অবস্থায় আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়েছে এবং আমার কোনো সমস্যা হয়নি। এ ছিল নির্ভেজাল একটা মিথ্যা কথা। কিন্তু ওদের সঙ্গে তর্ক করার কোনো অবকাশ বা সুযোগ ছিল না। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়া। আমার মনে মনে এই আশা যে, আমাকে আর এখানে ফিরে আসতে হবে না। আমি কাগজে সই করে দিলাম ।
আবার আমার দু’চোখ বাঁধা হলো। তারপর আমাকে বিরাট আকারের বেঞ্চ লাগানো একটি ভ্যানগাড়িতে চড়ানো হলো। ভ্যানের কাঠের বেঞ্চের ওপর বসতে হলো। সঙ্গের গার্ডরা বললো, এটা পুলিশবাহিনীর একটা প্রিজন ভ্যান। লম্বা রাস্তা পেরিয়ে পুরনো ঢাকার ভেতর দিয়ে এটা যাবে জেলা জজ আদালতের দিকে। চোখে কিছু না দেখলেও মানসচক্ষে ছোটকালের কথা মনে পড়ে যায়। কোলকাতায় আমার জন্মÑ সেখান থেকে ৯-১০ বছর বয়সে আমরা চলে আসি ঢাকায় এবং এই শহরেই আমি বড় হয়েছি। এই শহরের প্রায় সবকিছুই আমার জানা। আমার বাবা ধর্মপ্রাণ একজন ব্যক্তি ছিলেন, আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপ-িত ও আলীয়া মাদ্রাসার একজন খ্যাতনামা প্রফেসর। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির কারণে দাঙ্গাবিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ থেকে হাজার হাজার মানুষ পূর্ববঙ্গে চলে আসে। দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয় শিক্ষার প্রসিদ্ধ প্রাণকেন্দ্র আলীয়া মাদ্রাসা স্থানান্তরিত করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল একজন সিনিয়র মুহাদ্দীস হিসেবে আমার বাবার ওপর। সে সময় পুরনো ঢাকা ছিল প্রাদেশিক রাজধানীর মূল কেন্দ্রবিন্দু, জনসংখ্যা মাত্র আড়াই লক্ষ। সবচাইতে প্রচলিত যানবাহনের মধ্যে ছিল চার চাকার ঘোড়ার গাড়ি। বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। পয়ঃনিষ্কাশন, টেলিফোন লাইন, টেলিভিশন, কলের পানি, এসব ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এর পরেও এখানে জীবনধারা ছিল অনেক শান্তিপূর্ণ, মনোরম, অন্তরঙ্গ এবং চ্যালেঞ্জিং। আমরা থাকতাম নিম্ন আদালতের কাছেই ইসলামপুরে সরকারি একটি বাড়িতে। এলাকাটা ছিল শাঁখারী বাজারের কাছাকাছি। সুদক্ষ স্বর্ণশিল্পী ও শাঁখাশিল্পী কারিগররা এই অঞ্চলে বাস করতেন। যুগ যুগ ধরে সেখানে হিন্দুদের পূজার মৌসুমি মহোৎসব হতো। তাদের আপ্যায়নে মুখরোচক খাবারের বিষয়টি কোনোদিনই ভুলার নয়। তার কাছেই ছিল সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুল। এই স্কুলে ১৯৪৮ সালে আমাকে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।
ট্রাফিক জ্যাম থাকায় গাড়ি আস্তে চলছিল। তারপরও আমরা ঠিক কোথায় আছি তা মনে মনে নির্ণয় করার চেষ্টা করছিলাম। খুব সম্ভবত তখনো আমরা যাচ্ছিলাম ঢাকার নতুন অংশের ভেতর দিয়ে। এই ঢাকা শহর চারপাশে দ্রুত বিস্তার ঘটাচ্ছে। প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এখন এখানে বসবাস করে এবং ঢাকা ২০১২ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রধান ১০টি মেগাসিটির একটা হবেÑ এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। বিগত ৬০ বছর যাবৎ এই ঢাকা শহরে বসবাসকালে আমি এর প্রতিটি স্তরে প্রতিটি উন্নয়নের সাক্ষী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় গোটা দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। পরবর্তী ৩৮ বছরে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটিতে। একজন বাংলাদেশপ্রেমীর জন্য এ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। একসময় এখানকার অপ্রশস্ত রাস্তায় ছিল কেরোসিনের বাতি। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন মই নিয়ে সেই বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত। আজ সেখানে প্রশস্ত রাজপথ ও প্রতিরাতে রাজপথে হাজার হাজার সোডিয়াম বাতি জ্বলে।
মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। নগরায়নের স্বার্থে শত শত বছরের পুরনো বটগাছ ও কৃষ্ণচূড়াগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে বুলডোজার দিয়ে প্রতিনিয়ত দলিত মথিত করা হচ্ছিল। চারদিক থেকে পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদে মিছিল করে শাহবাগ থেকে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এলাকা মুখরিত করে রাখছিল। পদের উন্নয়নমুখী জীবনযাত্রার এই গতিপ্রবাহে ঢাকাকে নতুন অবয়ব দেওয়ার জন্য রাস্তায় সারিবদ্ধ কৃষ্ণচূড়া, শেফালী, শিমুল, কাট গোলাপ ও কাঁঠালচাপা গাছগুলোকে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছিল মাটির সাথে। শুধু ঢাকা কেন, সারা দেশেই দ্রুত পরিবর্তনগুলো ঘটে যাচ্ছিল। কেরোসিনের বাতির জায়গায় নিওন বাতি, মেথর ও ডোম দিয়ে প্রতিদিন হাতে পরিষ্কার করা পায়খানা ও পয়ঃনিষ্কাশনের জায়গায় স্বয়ংক্রিয় ফ্লাশিং ওয়াটার, তালপাতায় বানাানো হাতপাখার স্থলে সিলিং ফ্যান, টেলিপ্রিন্টারের জায়গায় ফ্যাক্স, পোস্টাল চিঠিপত্রের বদলে ই-মেইল, ল্যান্ড টেলিফোনের জায়গায় সেলফোন, সাদা-কালো টেলিভিশনের জায়গায় প্রমাণ সাইজের রঙিন টিভি, কাঠ ও শুকনো পাতা পোড়ানো চুলার জায়গায় গ্যাসের চুলাÑ এসব নাগরিক সুবিধা ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব সুযোগ-সুবিধা এখন সদর পল্লী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
আমার মনে আছে, যেদিন আমাদের বাসায় কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য কয়লার ইস্ত্রির বদলে একটি বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি ও রুটি সেঁকার জন্য টোস্টার নিয়ে আসা হলো সেদিনের অপরিসীম আনন্দের কথা। অ্যানালগ একটি টেলিফোন পরিস্থাপনের বিষয়টি ছিল বিরাট এক ঘটনা। নয় ভাই ও তিন বোনকে ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আমার স্নেহময়ী মা যখন আমাদের খাবার দিতেন তখন বাড়িটাতে নেমে আসতো উৎসবের আনন্দ। আমাদের সবার খাওয়া শেষ হওয়ার আগে মা ও বাবাকে কোনোদিন আহার করতে দেখিনি। কোনো কারণে আমাদের কারো একদিন বাসায় ফিরতে দেরি হলে তার না ফেরা পর্যন্ত মা না খেয়ে অপেক্ষা করতেন। আর যত দেরিই হোক না কেন মা প্রথমে বাবাকে খাবার বেড়ে দিয়ে তারপর নিজে খেতে বসতেন।সূত্র মানবজমিন
Dhaka, Bangladesh সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:17 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:58 AM |
Asr | 2:58 PM |
Magrib | 5:18 PM |
Isha | 6:39 PM |