আজ বৃহস্পতিবার | ১৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ |২রা রজব, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১০:৪৭
মহিউদ্দিন খান মোহন:- অসুস্থ রাজনীতির মহামারি অনেককেই ভারাক্রান্ত করেছে। দেশের রাজনীতির বর্তমান চেহারা-সুরত দেখে এরচেয়ে ভালো কোনো বিশেষণ এ মুহূর্ত মনে আসছে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটে গেল, তা আর যাই হোক সুস্থ রাজনীতির পরিচায়ক যে নয়, তা বিবেকবান মানুষদের বলে দিতে হবে না। অস্বীকার করা যাবে না, এই অসুস্থ রাজনীতির কবলে পড়ে আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব অনেকটাই ম্লান হয়েছে। একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি, অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের কারণে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন সুষ্ঠুভাবে হতে পারেনি।
যে কোনো জাতির জন্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর একটি গৌরবময় ঘটনা। আমাদের জন্যও তাই। বিশেষত আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, তাদের কাছে এর তাৎপর্য একটু ভিন্ন মাত্রার। আবেগটাও একটু অন্যরকম। এক জনমে একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হতে দেখা এবং তার পঞ্চাশ বছরপূর্তি প্রত্যক্ষ করা কম সৌভাগ্যের নয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, প্রত্যক্ষদর্শীর ইতোমধ্যে জীবনাবসান হয়েছে। তারা দেশটি স্বাধীন করেছেন, স্বাধীন হতে দেখেছেন। কিন্তু সে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার গৌরবময় ক্ষণটি প্রত্যক্ষ করতে পারলেন না। পঞ্চাশ বছরপূর্তির ক্ষণটিকে আড়ম্বরপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপনের আশা করেছিলাম। সব ভেদাভেদ ভুলে বাংলাদেশ পরিণত হবে মিলনমেলায়- এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক বিভেদ যে এর জন্য সর্বাংশে দায়ী তা বোধ করি বলার প্রয়োজন পড়ে না।
না সরকার, না বিরোধী দল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনে ঐকমত্যের প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারেনি। সরকার ইচ্ছা করলে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটিতে দেশের প্রধান সব রাজনৈতিক দলকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারত। অন্তত সরকারের পক্ষ থেকে সর্বদলীয় জাতীয় কমিটিতে অংশগ্রহণের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানানো যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। সরকারের ওই আহ্বানে যদি বিরোধী দল সাড়া না দিত, তাহলে সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব সর্বজনীন না হওয়ার দায়টা তাদের ওপর চাপানো যেত। অন্যদিকে সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির ভূমিকাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল না। তারা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের ঘোষণা দিয়ে যখন বলল, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পালন করবে, সঙ্গত কারণেই জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছিল, অন্তত স্বাধীনতার ইতিহাস প্রশ্নে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বৈরিতা কিছুটা হলেও কমে আসবে। কিন্তু দিবসটি উদযাপন করতে গিয়ে আলোচনা সভার মঞ্চে দলটির নেতৃবৃন্দ এমনসব কথা বললেন, তাতে ব্যবধান কমার পরিবর্তে তা আরও বাড়ল।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা যে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিল, তা ইতিহাসবিদরা ইতোমধ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তার ওই ভাষণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ বুঝে নিয়েছিল, তাদের পরবর্তী কর্তব্য কী। যারা স্বাধীনতার কথা ভাবছিলেন, তারা পেয়ে যান সমরসংকেত। এ সত্যটি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং জিয়াউর রহমানও স্বীকার করেছেন। তিনি তার ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবেন্ধ সে কথা অকপটেই উল্লেখ করেছেন। তার ওই নিবন্ধটি ১৯৭৩ বা ‘৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণটি গতানুগতিক রাজনৈতিক ভাষণ ছিল না। ওটা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা। তাছাড়া জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় কখনোই বলেননি যে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন আমাদের নেতা- এই সত্য অস্বীকারের কোনোই উপায় নেই। হতে পারে পরবর্তী সময়ে আমরা নানা রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী হয়েছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে চলেছি। তাই বলে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সত্যকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। পাশাপাশি এ সত্যকেও অস্বীকার করা যাবে না যে, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেছিলেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব সত্যকে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে যে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে পূর্ণাঙ্গ করা যাবে না- রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তা বুঝতে হবে।
সুবর্ণজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে হেফাজতে ইসলাম নামের রহস্যময় সংগঠনটি। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাশ মোদির এ উপলক্ষে বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসের তাণ্ডব সৃষ্টি করে। ফলে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে। নরেন্দ্র মোদি তার দেশে সমালোচিত না সমাদৃত সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। হেফাজত ভারতে মোদি সরকার কর্তৃক মুসলিম নির্যাতনের কথা বলেছে। সে রকম নির্যাতন যদি ভারতে হয়েই থাকে, তাহলে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় কেন তার প্রতিবাদ করছে না বা করল না? সব প্রতিবাদের ঠিকাদারি কি আমাদের নিতে হবে?
হেফাজত নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমন ঠেকাতে যে কর্মসূচি নিয়েছিল, তা কোনোমতেই শান্তিপূর্ণ থাকেনি। হেফাজত নেতাদের এটা স্মরণ রাখা উচিত ছিল, বংলাদেশ ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদিকে নিমন্ত্রণ করেনি, করেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। ভারত মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে। আমাদের এক কোটি মানুষকে তারা একাত্তরে আশ্রয় দিয়েছিল। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ যদি ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলে তার প্রতিবাদ করা আমাদের শুধু দায়িত্ব নয়, কর্তব্যও বটে।
কথা উঠেছে হেফাজতে ইসলামের লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে। নিজেদেরকে অরাজনৈতিক এবং ইসলামী সংগঠন হিসেবে পরিচয় দিলেও কাজ-কারবার পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক। তারা মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক ইস্যুতে মাঠ গরম করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস পায়। কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে তাদের বাড়াবাড়ি দেখেছি। এই সংগঠনটির নানা অপতৎপরতার পেছনে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, সরকারের উচিত তা উদ্ঘাটন করা। সরকারের উচিত গণতন্ত্রকে অবারিত করে দেশে সুস্থ রাজনীতির আবহ তৈরিতে যত্নবান হওয়া। অন্যথায় অসুস্থ রাজনীতির আবর্তে আমরা ঘুরপাক খেতেই থাকব।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক
Dhaka, Bangladesh বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৫ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:21 AM |
Sunrise | 6:41 AM |
Zuhr | 12:02 PM |
Asr | 3:04 PM |
Magrib | 5:24 PM |
Isha | 6:44 PM |