আজ সোমবার | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সকাল ৯:০৬
ডেস্ক: – উত্তরা আবাসিক এলাকার ১২ নম্বর সেক্টর সংলগ্ন তুরাগ থানাধীন নলভোগ ও রানাভোলা মৌজায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘রূপায়ন সিটি উত্তরা’। কিন্তু এই প্রকল্পে সংঘটিত হয়েছে মেগা দুর্নীতি ও প্রিমিয়াম জালিয়াতি, যাতে রূপায়ন গ্রুপকে সঙ্গ দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
সিটি জরিপ অনুযায়ী, রূপায়ন সিটির ভেতরে থাকা প্রায় ৩ একর জমির মালিকানা কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর আওতাধীন ভাওয়াল রাজ এস্টেটের। প্রকল্পের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলেই হাতের বাম পাশে পড়বে এই জমিটি। এখানে প্রায় ৩০ লাখ স্কয়ার ফিটের বিজনেস কাম শপিং সেন্টার নির্মাণ করছে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড। এই জমি নিয়ে মামলা চলমান থাকায় আদালত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়ার পরও নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে রূপায়ন।
এখানেই শেষ নয়, ভাওয়াল রাজ এস্টেটের এই জমির সাথে স্থানীয়দের বেশ কয়েকটি জমি নিজের নামে ভুয়া মালিকানা দেখিয়ে বাণিজ্যিক শ্রেণিতে রূপান্তরিত করে নিয়েছেন রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলী খান (মুকুল)।
রূপায়ন সিটি উত্তরায় ‘মেগা জালিয়াতি’
রূপায়ন চেয়ারম্যান দ্বারা অনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে রাজউকের সুপারিশে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখা-৩ ভূমি শ্রেণি পরিবর্তন করে গেজেট প্রকাশ করেছে।
শ্রেণি পরিবর্তনের পর এই জমিতে নকশা অনুমোদন করে নির্মাণ অনুমোদনপত্র দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। অথচ রূপায়ন সিটি উত্তরা প্রকল্পের বহু জমির মালিকানা নিয়ে চলমান রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। রয়েছে আদালতের স্থিতাবস্থা। তারপরও দেশের বিচারব্যবস্থাকে স্পষ্টভাবে অবজ্ঞা করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট একের পর এক নির্মাণ করে চলেছে বহুতল ভবন।
এসব ভবনের নির্মাণ অনুমোদন বাতিলের আবেদনের পরিপেক্ষিতে গত ৩০ জুলাই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউক চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিলেও ফাইলচাপা পড়েছে এই চিঠি।
এই চিঠির বিষয়ে অগ্রগতি জানতে গেলে গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজউক চেয়ারম্যান মো: আনিছুর রহমান মিঞা জুমবাংলাকে জানান, তিনি এখনও চিঠিটি দেখেননি।
রূপায়ন সিটি উত্তরা নামে অনুমোদনকৃত নকশাসহ আরও তিনটি নকশা বাতিলপূর্বক দায়ীদের বিরুদ্ধে তদন্তক্রমে আইনানুগ/বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি প্রদানের আবেদনটি করেছিলেন মোঃ মোস্তফা জামান নামে একজন ভুক্তভোগী।
এসকল অভিযোগের বিষয়ে রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলী মুকুলের বক্তব্য নেয়ার জন্য বিধিমোতাবেক সকল পন্থায় যোগাযোগ করা হলেও চেয়ারম্যানের দফতর কিংবা রূপায়ন গ্রুপ থেকে কোনও বক্তব্য আসেনি।
তবে রাজউক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, তিনি রূপায়ন সিটি উত্তরার বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিবেন।
আর যাদের জমি দখল হয়ে গেল, সেই কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর আওতাধীন ভাওয়াল রাজ এস্টেট যেটি ভূমি সংস্কার বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হয় সেটির চেয়ারম্যান মোঃ আবু বকর ছিদ্দীক এই বিষয়ে কোনও খোঁজ-খবরই রাখেন না। এমনকি তিনি এই বিষয়ে বক্তব্য দিতেও রাজি নন।
এই জমি নিয়ে চলমান মামলা ও আদালতের স্থিতাবস্থা থাকার পরও নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে রূপায়ন।
আলোর নিচে ঘোর অন্ধকার:
১২০ ফুট প্রশস্ত ঝকঝকে–তকতকে সড়ক। তার দুই পাশ ও মাঝের সড়কদ্বীপে পাম, খেজুরসহ নানা প্রজাতির গাছ। ফুটপাতে গাছের নিচে সময় কাটানোর জন্য আছে বসার জায়গা। সড়কবাতিগুলোও বেশ দৃষ্টিনন্দন।
মনোরম এই পরিবেশেই গড়ে উঠছে সারি সারি ভবন। প্রতিটি ভবনের নকশাও আবার একই রকম। ভবনের সামনে-পেছনে খোলা জায়গা থাকায় অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর থেকেই রয়েছে আকাশ দেখার সুযোগ। রাজধানী ঢাকার উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের শেষ মাথায় এমনই এক আধুনিক শহর গড়ে তুলছে রূপায়ন গ্রুপ।
রূপায়ন সিটি উত্তরা নামের এই প্রকল্পে স্কুল, খেলার মাঠ, মসজিদ, ব্যায়ামাগার, সুপারশপ, শপিং মল, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চার তারকা মানের হোটেলসহ সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকছে। তবে এই আলো ঝলমলে শহরের নিচে রয়েছে ঘোর অন্ধকার।
উত্তরার প্রকল্প এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে এবং এ সংক্রান্ত নথিপত্র ঘেঁটে রূপায়ন সিটি উত্তরার নানা অনিয়িম ও প্রতারণার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাজউকের সহযোগিতায় অন্যের জমি নিজের দেখিয়ে প্রকল্পের ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন নেয়া হয়েছে। অসদুপায়ে নেয়া হয়েছে ড্যাপ রিভিউ কমিটির ছাড়পত্র। এক অথরাইজড অফিসারের এলাকার প্রকল্পের অনুমোদন নেয়া হয়েছে অন্য অথরাইজড অফিসারের কাছ থেকে। মোট কথা পদে পদে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
২০১৫ সালের ১৮ মে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখা-৩ থেকে রূপায়ন হাউজিংয়ের আবাসিক জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়ে ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়। নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব জমির ভূমি শ্রেণি পরিবর্তন করে রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলী খান মুকুলের নামে গেজেট হয়েছে, সেসব জমির অনেকগুলোরই মালিক নন রূপায়ন চেয়ারম্যান। এগুলোর কোনটার মালিক সরকার, আবার কোনটা অন্য স্থানীয় ব্যক্তিদের মালিকানাধীন।
গেজেটে যেসব আরএস দাগ উল্লেখ রয়েছে এগুলোর মধ্যে ৯৫৮ নম্বর দাগের সম্পত্তির মালিকানা ভাওয়াল রাজ এস্টেটের। এই দাগে জমি রয়েছে ২৯৭ শতাংশ। এই জমি নিজেদের দাবি করে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার প্রথম যুগ্ম জজ আদালতে ভাওয়াল রাজ এস্টেটের বিরুদ্ধে মামলাও করে রূপায়ন গ্রুপ।
মামলায় রূপায়ন গ্রুপ দাবি করে, সিএস ও এসএ জরিপে এই জমি কেরু মাদবর ও তার ওয়ারিশদের দখলে ছিল। ওয়ারিশদের কাছ থেকে জমি কিনেছে রূপায়ন। কিন্তু সিটি জরিপে এই জমি ভাওয়াল রাজ এস্টেটের নামে রেকর্ড হয়েছে।
রূপায়ন গ্রুপের এই মামলায় জমির সিএস ও এসএ দাগ উল্লেখ করা হয় যার নম্বর ৬০০। রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের পক্ষে রূপায়ন গ্রুপের এজিএম (ল্যান্ড) সাজ্জাদ হোসাইন মামলার বাদী হয়েছেন যার নম্বর ৫/২০১৩।
মামলাটির অগ্রগতি জানতে সাজ্জাদ হোসাইনের সঙ্গে গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর দুইবার ফোনে কথা হলে তিনি জানান, রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে তিনি আপটেড জানাবেন। পরে অবশ্য তিনি বা রূপায়ন গ্রুপের কোনও প্রতিনিধি জুমবাংলাকে মামলার অগ্রগতি জানায়নি।
এদিকে রূপায়ন গ্রুপ ড্যাপ রিভিউ কমিটির কাছে ভূমি শ্রেণি পরিবর্তনের যে আবেদন করে সেখানে আরএস দাগ উল্লেখ করেছে। রূপায়ন গ্রুপের করা মামলাসহ অন্য আরও একাধিক মামল চলমান থাকার পরও রাজউকের সুপারিশে রূপায়ন চেয়ারম্যানের নামে ভূমি শ্রেণি পরিবর্তন করে গেজেট প্রকাশ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
সরকারি জমির পাশাপাশি বেশ কয়েকজন স্থানীয় অধিবাসীর জমিও নিজের নামে গেজেটভুক্ত করে নিয়েছেন লিয়াকত আলী খান মুকুল। এদের মধ্যে একজন ভুক্তভোগী স্থানীয় হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য হাজী মোহাম্মদ মোস্তফা জামান। তার মালিকানাধীন ৭৯৫, ৭৯৯, ৮০০, ৮০১, ৮০২, ৯৫৭ ও ৯৬০ আসএস দাগের জমিও শ্রেণি পরিবর্তন করে গেজেটভুক্ত হয়েছে রূপায়ন চেয়ারম্যানের নামে।
এসব জমি নিয়ে দুই পক্ষেরই একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে মোস্তফা জামানের বিরুদ্ধে করা রূপায়ন গ্রুপের মামলা ঢাকার বিচারিক আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে রূপায়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে মোস্তফা জামানের করা মামলা সিনিয়র জেলা জজ এ.এইচ.এম হাবিবুর রহমান ভুঁইয়ার আদালত মনজুর করে অরবিট্রেটর সরদার মোহাম্মদ সুরুজ্জামানের দেয়া রায় বাস্তবায়ন করা এবং এই রায় বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত উভয় পক্ষের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করে।
তবে আদালতের রায় অমান্য করে উল্লেখিত দাগের জমিগুলোসহ আরও বেশকিছু জমি নিজের দখলে রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন রূপায়ন চেয়ারম্যান।
ভুক্তভোগী হাজী মোহাম্মদ মোস্তফা জামান জুমবাংলাকে জানান, রানাভোলা মৌজার সিএস দাগ ১৬৯ ও ১৬৮ এর ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ, নলভোগ মৌজার ৬০০, ৬০১, ৬০২, ৫৯৯, ৬২৫, ৬২৬, ৬১৮, ৬১৭, ৬১৯ নম্বর দাগের তার ও তার পরিবারের সদস্যদের ১৩৮ কাঠা জমির মধ্যে ৫৩ দশমিক ৭৫ কাঠা জমি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে এবং বাকি জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে রূপায়ন গ্রুপ। এর বাইরে রানাভোলা মৌজার-সিএস ১৭৯ দাগের ২৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ জমি কোনো ধরনের বায়না ছাড়াই সীমানা দেয়াল তুলে রূপায়ন সিটির ভেতরে নিয়ে নিয়েছে। জমিগুলো নিজেদের দেখিয়ে রাজউক থেকে প্লান নিয়ে ‘রূপায়ন সিটি উত্তরা’ গড়ে তোলা হয়েছে।
মোস্তফা জামানের মতো আরেক ভুক্তভোগী নলভোগ পূর্ব পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা হাজী মনির হোসেন। তিনি জানান, ২০০৩ সালে ৪৮ কাঠা জমি রেজিস্ট্রি বায়না করেছেন রূপায়নের কাছে। তাকে সামান্য কিছু টাকা পরিশোধ করেছে রূপায়ন হাউজিং। এরপর কয়েক বছর ধরে তাকে টাকা দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে আসছে।
হাজী মনির বলেন, বাপ-দাদার সম্পত্তি আমরা বিক্রি করতে চাইনি। কিন্তু রূপায়ন কর্তৃপক্ষ নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের জমি নিয়ে নিয়েছে। এ সময় রূপায়ন কিছু চেক দিয়েছে।
জানা গেছে, চেকগুলো নগদায়ন না হওয়ায় হাজী মনির রূপায়নের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার মামলা করেছেন। তার আগে মোস্তফা জামানও রূপায়নের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার মামলা দায়ের করেছিলেন।
এদিকে ২০০৪ সালের শুরুতে ফুলবাড়ীয়ার বাসিন্দা আলহাজ আবদুল কাদিরের ১০ শতাংশ জমি দখল করে নেয় রূপায়ন হাউজিং লিমিটেড। স্থানীয় লোকজনকে ধরে অনেক চেষ্টা করেও তিনি জমি উদ্ধার কিংবা জমির টাকা আদায় করতে পারেননি।
রূপায়ন সিটির প্রধান গেট সংলগ্ন ১৩ কাঠা জমি রয়েছে হরিরামপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল মালেকের। ২০০৪ সালে তার এ জমি কিনতে বায়না করে রূপায়ন সিটি। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে চুক্তির বাকি টাকা আর দেয়নি।
সূত্র জানায়, রূপায়ন সিটি উত্তরা প্রকল্পের আবাসিক ফেজে ৮টি ১০ তলা ভবন ও স্কুল-মসজিদের নকশা অনুমোদন করেন রাজউকের উত্তরা জোনের তৎকালীন অথরাইজড অফিসার মিজানুর রহমান। যদিও এটি ছিল তার এলাকার বাইরের প্রকল্প। জমির মালিকানা যাচাই-বাছাই না করেই তিনি নকশা অনুমোদন করে দিয়েছেন।
এই আলো ঝলমলে সিটির অনেকাংশই গড়ে উঠেছে অন্যের জমিতে
প্রকল্পে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা:
একসময় রূপায়ন গ্রুপের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা হাজী সিরাজুল ইসলাম জানান, রূপায়ন সিটি প্রকল্পের জমিগুলো স্থানীয়দের কাছ থেকে সংগ্রহের জন্য তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন রূপায়ন চেয়ারম্যান। পরে যখন তিনি দেখলেন, চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ না করেই রূপায়ন গ্রুপ স্থানীয়দের জায়গা দখল করে নিচ্ছে তখন তিনি রূপায়ন গ্রুপ থেকে সরে আসেন। হাজী সিরাজুল ইসলামের এই দাবির প্রেক্ষিতে রূপায়ন গ্রুপের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, রূপায়ন সিটি উত্তরা প্রকল্পের লে-আউট করা হয়েছিল ১১৪ বিঘা জমি টার্গেট করে। কিন্তু গ্রাহকদের কাছে প্রচার করা হচ্ছে ১৩৪ দশমিক ৫ বিঘা জমির ওপর এই প্রকল্প। এছাড়া বলা হচ্ছে, প্রকল্প এলাকার মোট আয়তনের ৬৩ ভাগ জায়গা খোলা রাখা হবে। কিন্তু বাস্তবে এটি একেবারে অসম্ভব। এছাড়া প্রকল্পের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সরকারি খালকে তারা নিজেদের প্রকল্পের লেক হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন গ্রাহকদের মাঝে। এমনকি ড্যাপের রাস্তাকে নিজেদের প্রকল্পের রাস্তা হিসেবে দেখাচ্ছে রূপায়ন। এ ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে রূপায়ন হাউজিং।
দখল-অত্যাচারের ইতিহাস পুরনো:
শুধু রূপায়ন সিটি উত্তরা নয়, নারায়নগঞ্জের ভুইগড়ে অবস্থিত রূপায়ন গ্রুপের আরেক প্রকল্প রূপায়ন টাউন নির্মাণের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে সরকারি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি দখল, অত্যাচার-নির্যাতনের অনেক ঘটনা। এমনকি জমির পাওনা টাকা চাওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান রাসেলকে খুনের অভিযোগও রয়েছে এই গ্রুপের বাহিনীর বিরুদ্ধে।
২০০৯ সালের অক্টোবরে রাসেলকে বুকে ও মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে রূপায়ন টাউন প্রকল্পের ভিতরে ফেলে রেখেছিল দুবৃত্তরা। তার পরিবারের ৫২ শতাংশ জমির বায়না করে টাকা না দিয়েই রূপায়ন টাউন জমি ভরাট করার প্রতিবাদ করেছিল রাসেল। খুন হওয়ার পর রাসেলের পরিবারের বিরুদ্ধে উল্টো ১৭টি মামলা দেয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে জাল দলিল ও ভুয়া মালিক সৃষ্টি করে মনর উদ্দিনের ওয়ারিশদের ৪৪ শতাংশ জমি দখলে নেয়ার অভিযোগ রূপায়নের বিরুদ্ধে। গ্রুপটি এখানে খাস জমিও দখলে নিয়েছে। ভুঁইগড় মৌজাস্ত আরএস-৩৯২৪, ৩৯২৫ ও ৩৯১১ নম্বর দাগের ৭৩ শতাংশ খাস জমিতে প্রকল্প গড়ে তুলেছে রূপায়ন। আইন অনুযায়ী, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, পার্ক সহ জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম ছাড়া কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খাস জমি ব্যবহার করা যায় না।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পত্তিও রূপায়নের দখলদারিত্ব থেকে রেহাই পায়নি। ফতুল্লার ভুঁইগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন সর্দারের ৪২ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখলের অভিযোগ আবাসন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
লেগে আছে পোড়া লাশের গন্ধ:
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২৩ তলা এফআর (ফারুক-রূপায়ন) টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। এই ভবনের অনুমোদন ১৮ তলা থাকলেও জমি মালিক এস এম এইচ আই ফারুক, রূপায়ন গ্রুপ ও রাজউকের যৌথ দুর্নীতিতে ২৩ তলা ভবন ওঠে এখানে। অগ্নিকাণ্ডের পরপরই পুলিশ যে মামলা করেছিল তাতে অন্যতম আসামী রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল।
নীতির ঘরেই দুর্নীতি:
রূপায়ন গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী একটি জাতীয় দৈনিক যেটি সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে সুনাম অর্জন করেছে। এই সংবাদপত্রটি রূপায়ন গ্রুপের যে ভবনে বসেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে কাজ করে যাচ্ছে সয়ং সেই ভবনেও সংগঠিত হয়েছে জালিয়াতি-প্রতারণার ঘটনা।
রাজধানীর বাংলামোটরে অবস্থিত রূপায়ন ট্রেড সেন্টারের সাড়ে ২১ হাজার বর্গফুট স্পেস প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের কাছে ২০১০ সালে বিক্রি করেছিল রূপায়ন। এরপরও ২০১২ সালের ৮ জুন আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওই স্পেস বিক্রি করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এখানেই শেষ নয়, রেজিস্ট্রেশনে স্পেসের মূল্য কম দেখিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয় ২ কোটি টাকার বেশি। এছাড়াও রূপায়ন সিটি উত্তরা প্রকল্পেও জমির দাম অনেক কম দেখিয়ে বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার প্রমাণ রয়েছে রূপায়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে।
যে ৫ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি রূপায়ন:
অভিযোগগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলী খান মুকুলের ব্যক্তিগত ফোনে কল দেওয়া হয়। এসময় ফোনটি রিসিভ করেন তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। তাকে ফোন দেয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানালে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে তার বক্তব্য নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার কথা বলেন। এর কিছুক্ষণ পর রূপায়ন গ্রুপের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর হাবিবুর রহমান পলাশ ফোন করেন এই প্রতিবেদককে। তিনি প্রশ্নগুলো লিখিতভাবে দিতে বললে সন্ধ্যার মধ্যে উত্তর দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রশ্ন পাঠানো হয়। কিন্তু একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রশ্নের উত্তর পাঠায়নি রূপায়ন কর্তৃপক্ষ।
রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যানের কাছে যে প্রশ্নগুলো পাঠানো হয়েছিল সেগুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
১. তুরাগ থানাধীন নলভোগ মৌজার সিএস দাগ ৬০০ জমিটি ভাওয়াল রাজ এস্টেটের নামে রেকর্ডকৃত। কিন্তু সিএস ও এসএ জরিপমতে এই জমি রূপায়ন গ্রুপ নিজের সম্পত্তি দাবি করছে। এই বিষয়ে আপনার স্বপক্ষে বক্তব্য কি?
২. ভাওয়াল রাজ এস্টেটের নামে রেকর্ডকৃত জমটি কিভাবে রূপায়ন চেয়ারম্যানের নামে ভূমি শ্রেণি পরিবর্তন করে গেজেট প্রকাশিত হলো? এখানে রাজউকের কর্মকর্তাদের অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে কিনা?
৩. রূপায়ন টাউন ও রূপায়ন সিটি উত্তরা প্রকল্পের অনেক জমি তার মালিকদের প্রাপ্য মূল্য বুঝিয়ে না দিয়ে দখলে নেয়া হয়েছে কিংবা জোরপূর্বক দখলে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
৪. সরকারি জমিতে এবং অন্য ব্যাক্তির জমিতে রূপায়ন সিটি উত্তরা গড়ে তোলার অভিযোগে একাধিক মামলা চলমান থাকার পরও কিভাবে রাজউক থেকে নকশা ও নির্মাণ অনুমোদন নেয়া হয়েছে?
৫. বিবাদমান জমিগুলোতে আদালতের স্থিতাবস্থা থাকার পরও কিভাবে এখানে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে? সুএ: জুমবাংলা’
Dhaka, Bangladesh সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:17 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:58 AM |
Asr | 2:58 PM |
Magrib | 5:18 PM |
Isha | 6:39 PM |