আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৬:৫৮
সাংবাদিক কাদের গনি চৌধুরীঃ- আজ ১৯ জানুয়ারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী বাংলাদেশের সবচেয়ে জননন্দিত রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী থানার বাগবাড়িতে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে গভীর রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের হাতে ৪৫ বছর বয়সে তিনি নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন।
আজ একথা শতভাগ সত্য যে, সৈনিক জিয়া মহান। রাষ্ট্রনায়ক জিয়া মহত্তর। তিনি গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। বিশ্ব রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন ভিশনারি এক স্বপ্নদ্রষ্টা। জিয়া জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দিতে চেয়েছিলেন জাতিকে সম্মান আর গৌরব।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষনজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম, পরিশ্রমপ্রিয়তা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলি এ দেশের গণমানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্যে তা জোটেনি। মাত্র ছয় বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার ওপর ছিল প্রচণ্ড আস্থাশীল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার ওপর মানুষের এই আস্থায় কোনো চিড় ধরেনি।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সৎ শাসক জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী থানার বাগবাড়িতে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মনসুর রহমান কলকাতায় একজন কেমিস্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। শৈশব ও কৈশোরের একটি সময় গ্রামে কাটিয়ে পিতার সাথে কলকাতায় এবং দেশ বিভাগের পর করাচিতে চলে যান জিয়াউর রহমান। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার সাথে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার কোম্পানি যুদ্ধে সবচেয়ে অধিক খেতাব লাভ করে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জন্য তিনি নিজেও একটি পিস্তল উপহার পান। সৈনিকজীবনে তিনি যেমন চরম পেশাদারিত্ব দেখিয়েছেন ঠিক জাতীয় সব সঙ্কটকালেও শক্ত হাতে হাল ধরেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যখন নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নেতারা যে যে দিকে পারেন আত্মগোপন কিংবা পালিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বিশ্বসম্প্রদায়কে বাংলাদেশের মানুষের এ ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে সমর্থনের আবেদন জানান। ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে তিনি একটি সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে সমরনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। শহীদ জিয়াকে তারা স্বাধীনতার ঘোষক পর্যন্ত স্বীকার করতে চান না। অথচ শুধু বাংলাদেশেরই নয় বিশ্ববাসী জানেন জিয়াই স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক।
বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় এবার প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত লেখক গবেষক এবং এক সময়ের জাসদ নেতা মহিউদ্দিন আহমদের আলোচিত বই ‘বিএনপি সময় অসময়’-এর ১৭৫ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলো লেখা আছে। বইটির বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কথা স্থান পায়। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বই ও দলিল উদ্ধৃত করে বইটিতে লেখা হয়, ‘‘জিয়াউর রহমানের কথা প্রথম শোনা যায়, ১৯৭১ সালে। তার নেতৃত্বের স্ফূরণ ঘটেছিল ওই সময়েই, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে হানাদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তার রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়া ও অন্য অবাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও হত্যা করে জিয়া বিদ্রোহ শুরু করেন। তিনি চট্টগ্রামের অসামরিক টেলিফোন অপারেটরকে এরপর বলেন, চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার, পুলিশের এসপি, ডিআইজি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জিয়া যে তার সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন, তা তার সহকর্মীরা সবাই সমর্থন করেন। এই একটি চরম মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহের সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিলেন। তার সঙ্গে মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন, লে. শমসের মবিন চৌধুরী, লে. মাহফুজুর রহমান এবং অষ্টম বেঙ্গলের অন্যান্য বাঙালি সদস্যও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন। বিদ্রোহের পর ২৭ মার্চ, চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জিয়া পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। তার কণ্ঠস্বর ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’, দিশেহারা মানুষকে স্বস্তি দিয়েছিল, উদ্দীপনা যুগিয়েছিল।’’
একাত্তরের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের ‘উই রিভোল্ট’ বলে হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে অন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করে প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার দুঃসাহসিক এবং একইসঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনা আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রী এবং তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বহুদিন ধরে দুঃসহ এক বোঝার মতো হয়ে আছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের উজ্জ্বল উপস্থিতি খাটো করতে তারা সব সময়ই নানা বিতর্কের অবতারণা করেন। তারা জিয়াকে নিয়ে কূট মন্তব্য করেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এই বীরকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এবং স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলে আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠিত হন না। কিন্তু সত্য ধামাচাপা দেয়া যায় না। তারা মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে যতোই খাটো কিংবা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন, ততোই তা যেন আরও দ্বিগুণ শক্তিতে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বই এর উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক যারাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন, বই লিখছেন তাদের বইয়ে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা গৌরবের সঙ্গেই উঠে আসছে। উঠে আসছে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছিলেন এবং এই ঘোষনাটি তিনি নিজের হাতে নিজেই লিখেছিলেন। মেজর জিয়া যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বলেন, ‘উই রিভোল্ট’, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি আর কেবল একজন মেজরই নন, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারণ এই পরম আকাংখিত ঘোষণাটির অপেক্ষায় ছিল স্বাধীনতাকামী জনগন। তাই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বেতার ভাষণে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরবর্তীতে তার নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্সের যুদ্ধকে স্টালিনগ্রাডের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খোন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জার কথোপকথন নিয়ে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ শীর্ষক বইয়ে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে স্থান পেয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ কে খোন্দকার ছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী, মঈদুল হাসান ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, তাজউদ্দীন আহমদ-এর বিশেষ সহকারী ও মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের লেখক এবং এস আর মীর্জা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক।
কথোপকথনে এ কে খোন্দকার বলেন, ‘‘২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অবশ্য মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথমেই যে ঘোষনাটি দেন, সেটি ভুলভাবে দেন। সেই ঘোষনায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করেছিলেন। যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোণা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়েও শুনেছি মেজর জিয়ার ঘোষনাটি তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল। তার এ ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারাদেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যতো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে, হ্যাঁ, এবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামলো। জিয়ার ২৭ মার্চ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা ছিল, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচন্ড উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়।’’
মঈদুল হাসান বলেন, ‘‘অন্যের কথা কী বলবো, মেজর জিয়ার বেতার ঘোষণা শুনে আমি নিজে মনে করেছিলাম যে Ñ না, সত্যি তাহলে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক লোক বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে। এটা আমার মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং আমি উৎসাহবোধ করি। আমি আশপাশে যাদের চিনতাম, তারাও এই ঘোষণায় উৎসাহিত হয়। সুতরাং জিয়ার সেই সময়টুকুর সেই অবদান খাটো করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’’
এস আর মীর্জা বলেন, ‘‘২৫ মার্চের পরে আমি সব সময় রেডিও সঙ্গে রেখেছিলাম। এম এ হান্নান সাহেবের ঘোষণা আমি শুনিনি। ২৭ মার্চের বিকালে পরিস্কার শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন। এই ঘোষণা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে, হ্যাঁ এখন মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ তাদের সঙ্গে বাঙালী সেনারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে।’’
এ কে খোন্দকারের সাম্প্রতিক সাড়া জাগানো বই ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’-এর ৫৯, ৬০ ও ৬১ নম্বর পৃষ্ঠায় মেজর জিয়ার ঘোষণা সম্পর্কে তার উপরোক্ত বক্তব্য ছাড়াও তিনি লিখেন, ‘‘মেজর জিয়া চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণা দিলেন, সেটা ভুলভাবেই দিলেন। কারণ তিনি প্রথম ঘোষণায় নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে সংশোধন করে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সেটি টেপে ধারণ করা হয় এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে তা পুনঃপ্রচার করা হয়। আর এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটল। … রেডিওতে আমি মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনেছি। আমি ওই সময় জিয়াকে চিনতাম না। তবে এই ঘোষণায় আমি স্বস্তিবোধ করলাম এবং আশ্বস্ত হলাম যে অন্তত মেজর পর্যায়ের একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এই যুদ্ধে জড়িত হয়েছেন।… সেই সংকটময় মুহূর্তে জিয়ার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস যোগায়। … মেজর জিয়া যে কাজটি করতে পেরেছিলেন, তা করা উচিত ছিল জাতীয় পর্যায়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের এবং এর জন্য তাঁদের একটা পূর্ব পরিকল্পনাও থাকা প্রয়োজন ছিল।’’
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ বইটি। এতে বলা হয়, ‘‘কালুরঘাটে চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী বেলাল মোহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমান (পরবর্তী সময়ে জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট) ২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি সে সময় বাঙালী সৈনিকদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল।’’
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের সম্পাদনায় বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার ৪৯ নম্বর পাতায় মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে লেখা হয়, ‘‘একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনারা বাঙালী হত্যার অভিযানে লিপ্ত হবার পর তাদের হাতে বন্দী হন শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সংকটময় মুহূর্তে একাত্তরের ২৬ ও ২৭ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বাংলাদেশের পূর্ব বিঘোষিত পতাকা সমুন্নত রাখে। মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মেজর জিয়া এবং তার বাহিনী সামনের সারিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তারা বেশ কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন। মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় জিয়াউর রহমান বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১ নং রণাঙ্গণের অধিনায়ক হিসেবে এবং ‘জেড’ ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান একজন অসম সাহসী যোদ্ধা হিসেবে প্রতিরোধ আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। তার বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতার পর তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।’’
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক মরহুম হুমায়ুন আহমদ তার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে উল্লেখ করেন ‘‘একাত্তরের ২৭ মার্চ শনিবার রাত আটটায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভূত একটা ঘোষণা শুনতে পায়… মেজর জিয়া নামের একজন নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভেতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়… তাদের নেতিয়ে পড়া মেরুদন্ড একটি ঘোষণায় ঋজু হয়ে যায়…তাদের চোখ ঝলমল করতে থাকে। একজন অচেনা অজানা লোকের কণ্ঠস্বর এতোটা উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে ভাবাই যায় না।’’
মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তাঁর [Bangladesh at War, Academic Publishers, Dhaka 1989] বইয়ের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য সবাইকে আহবান জানান। এতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান রূপে ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আরেকটি ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সামরিক সর্বাধিনায়করূপে আমি মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’’
মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক-উল ইসলাম (বীর উত্তম) তাঁর ÔA Tale of MillionsÕ বইয়ের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান রূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন।’’ কেন জিয়া মত পরিবর্তন করেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মেজর রফিক-উল-ইসলাম। ‘‘একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান রূপে ঘোষনা দিলে এই আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য এই গণ-অভ্যুত্থান সামরিক অভ্যুত্থানরূপে চিত্রিত হতে পারে, এই ভাবনায় মেজর জিয়া পুনরায় ঘোষণা দেন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে। এই ঘোষনা শোনা যায় ২৮ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত।’’
মেজর এম এস এ ভূঁইয়া (সুবিদ আলী ভূঁইয়া) তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘এখানে মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বেতার কেন্দ্র থেকে যাঁরা সেদিন মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাঁদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তাঁর প্রথম দিনের ভাষণে নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন।’’ তিনি আরও লিখেন… ‘‘স্বাধীনতার ঘোষণা কার নামে প্রচারিত হয়েছিল সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা এই যে, জিয়াউর রহমান নিজে উদ্যোগ নিয়েই এই ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। এতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কতটুকু সুবিধা হয়েছিল তাও বিচার্য।
১৯৭১-এর মার্চে তরুণ ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (পরবর্তীতে কর্নেল) যিনি মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার সময় তাঁর সঙ্গেই ছিলেন, পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। কর্নেল অলি আহমদ (বীর বিক্রম), অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের অনুবাদ গ্রন্থে Ñ (রাষ্ট্র বিপ্লব : সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৮) বলেছেন, ‘‘মেজর জিয়া ছিলেন আমাদের নেতা এবং বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।’’
মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী (বীর উত্তম), (পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) লিখেছেন, ‘‘অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এবং পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিলে আমি সানন্দে যুদ্ধে যোগদান করি।’’ এছাড়াও ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ মীর শওকত আলী (বীর উত্তম)-এর একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় বাংলাভিশন চ্যানেলে। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মেজর জিয়া রিভোল্ট করেন এবং পরে নিজের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’’
কূটনীতিক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুহাম্মদ নূরুল হুদা তার ‘দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা’ শীর্ষক বইয়ের ১৯ পৃষ্ঠায় লিখেন‘‘২৭ মার্চ শনিবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন, ওই দিন চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া তার গুরুগম্ভীর ও তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়াকে তখন চিনতাম না। ওই দিনের আগে তার নামও কোনদিন শুনিনি, তবুও ওই পরিস্থিতিতে মেজর জিয়ার কণ্ঠে ঐতিহাসিক সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে মনে উৎসাহের জোয়ার বয়ে গেল। তখন বন্দী জীবন যাপন করে কেমন যেন মনমরা ও হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তাই মেজর জিয়ার কণ্ঠে এই ঘোষণা যেন আশার আলো দেখতে পেলাম। ঘোষণাটি খুবই সময়োচিত ছিল।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অলি আহাদ (মরহুম) তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫’ বইতে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে লিখেন, ‘‘আমি আবদুল গাফফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করিতাম এবং মাঝে মাঝে তাঁহার অভয় দাস লেনের বাসায় রাত্রিযাপন করিতাম। তাঁহার বাসায় রাত্রিযাপন করিতে গিয়া তাঁহারই রেডিও সেটে ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতর কেন্দ্র হইতে ‘স্বাধীন বাংলা রেডিও;র ঘোষণা শুনিতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কন্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশেহারা, হতভম্ব, সম্বিতহারা ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহবান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ। ভারতের সমরনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব ÔSurrender At DACCA : Birth of a NationÕ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘চট্টগ্রামের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমান রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বেতার ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণা অনেকেই শুনেছেন। যারা নিজ কানে শোনেননি তারাও মুখে মুখে চারদিকে প্রচার করেন। তিনি আরও বলেন, মেজর জিয়া বাঙালি রেগুলার ও আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের সহায়তায় চট্টগ্রামে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।’’
বাংলাদেশে ভারতের প্রথম ডেপুটি হাই কমিশনার জে এন দীক্ষিত তাঁর Liberation And Beyond : Indo-Bangladesh Relations বইতে লিখেন, ‘‘চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান স্বল্পকালীন পরিসরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং সেই কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণায় তিনি বাংলার সকল সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের আহবান জানান।’’
‘১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে মুক্তিযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেক্টর কমান্ডারদের উপস্থিতিতে জিয়াউর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয় এভাবে …২৫ মার্চ পাকবাহিনীর বর্বর হামলার পর চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী ও তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলার কৃতিত্বের অধিকারী কর্নেল জিয়াউর রহমান…‘তুমুল করতালির মধ্যে বক্তৃতা করতে ওঠেন তিনি।’’ (সূত্র : দৈনিক বাংলা, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)।
শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী সাবেক আমলা আবুল মাল আবদুল মুহিত তার বইয়ে উল্লেখ করেন, The next evening Major Zia announced the formatica of a provisional government under his and solicited the support of the world in the liberation of Bangladesh.
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান যখন ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে যান, তখন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সম্মানে দেয়া ২৭ ডিসেম্বর ’৭৭ ভোজসভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা স্মরণ করে বলেন, …“ইতোমধ্যে আপনার দেশের ইতিহাসের পাতায় একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দানকারী হিসেবে আপনার মর্যাদা এরইমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে জাতীয় অগ্রগতি ও জনকল্যাণে নিবেদিত একজন জননেতা হিসেবে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে আপনি গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।”
‘ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা সুখান্ত সিং যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং পরবর্তীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন, তিনি তার Zvi India’s Wars Since Independence : The Liveration of Bangladesh বইয়ে লিখেছেন, ‘ইতোমধ্যে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে একজন বাঙালি অফিসার মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।’’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান (মরহুম) লিখেছেন, ‘‘২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান নিজ দায়িত্বে নিজেকে বাংলাদেশের কমান্ডার ইন চিফ ও প্রভিশনাল রাষ্ট্রপ্রধান বলেছেন। এটা কেউ তাকে বলেনি।’’
শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’’
বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান রচিত ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধঃ একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা’ বইতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘‘মেজর জিয়া নিজেকে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।’’
বুদ্ধিজীবী ও লেখক বদরুদ্দিন উমর লিখেছেন, ‘‘মেজর জিয়াই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন আর সেটা সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রতিরোধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। সেটা ঘটেছিল এমন এক মুহূর্তে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব অকেজো হয়ে পড়েছিল।’’
২৮ মার্চ ১৯৭১। ভারতের ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘‘…১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘জিয়াউর রহমান’ এক অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ২৫ মার্চ রাতেই। আর এই ২৫ মার্চ মধ্যরাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন মেজর জিয়া। শুধু বিদ্রোহ ঘোষণাই করেননি, নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘোষণাটিও পাঠ করেছিলেন। সেই দুঃসময়ে বাঙালি জাতি ছিল দিশেহারা, দিকনির্দেশনাহীন। ঠিক এ সময়ে মেজর জিয়ার প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠের ঘোষনা ছিল তূর্যধ্বনির মতো। প্রথম ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন।’’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামীও স্বীকার করেছেন তিনি মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা নিজ কানে শুনেছেন। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা লেখেছেঃ একাত্তরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ২৭ মার্চ ’৭১ শেখ হাসিনা নিজ কানে শুনেছেন। আণবিক শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেনের মালিবাগ চৌধুরীপাড়া ঝিলপাড়ের বাড়িতে থেকে শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়া একসঙ্গে ওই ঘোষণা শুনেছিলেন। রেডিওতে প্রচারিত ঘোষণাটি শুনে সেদিন উজ্জীবিত হয়েছিলেন তারা।
১৯৯১ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা আণবিক শক্তি কমিশন অফিসে দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমদকে দেয়া এক দীর্ঘ সাক্ষারে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম. ওয়াজেদ মিয়া একথা জানিয়েছিলেন।
একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে যে নামটি বাংলাদেশের মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিল, সেই সমরনায়ক জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সেনানায়ক এবং পরে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন। বিএনপির মতো একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন যা ৩৮ বছর ধরে জনপ্রিয় দল হিসেবে রাজনীতিতে সগৌরবে টিকে আছে। মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, উৎপাদন, জাতীয় পরিচয়, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আজ জিয়াউর রহমানের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের কিংবদন্তি নেতা।
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |