আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৬:৫২
pnbd24:- মানব পাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলকে নিয়ে ব্যাপক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে সরকার।
সরকারের ভেতরে ও বাইরে এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা সমালোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানব পাচার করে কুয়েতের শ্রম বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন এই এমপি। একইসঙ্গে মানবপাচার ও অর্থপাচারের মতো অপকর্মের একজন শীর্ষস্থানীয় হোতা বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধির পরিচয় নিয়ে বিদেশে গ্রেফতার হওয়ায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। এতে বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাও তৈরি হয়েছে। কুয়েতে এমন অপকর্মের দায়ে বাংলাদেশি এমপির গ্রেফতারের ঘটনাকে ইতিমধ্যে ‘লজ্জাজনক’ ও ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তাঁর মতে, সারা বিশ্ব যখন মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, এমন সময়ে বাংলাদেশি একজন সংসদ সদস্যের আটকের খবর অনভিপ্রেত।
আব্দুল মোমেন বলেন, এই ঘটনা সত্যি হয়ে থাকলে খুবই দুঃখজনক। বিদেশে গিয়ে একজন সাংসদ এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবেন তা একেবারেই অনভিপ্রেত। এমন সময় এই ঘটনাটা ঘটেছে যখন পৃথিবীর সব দেশ মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। এমন সময়ে সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসাটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এতে লজ্জিত।
এদিকে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কুয়েতি আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন পাঁচ প্রবাসী বাংলাদেশি। সাক্ষীদের সকলকেই কুয়েতে পাচার করেছিলেন কাজী পাপুল। কুয়েতি আদালতকে তারা জানান, এজন্য তারা সাংসদকে তিন হাজার কুয়েতি দিনার দিয়েছেন।
স্থানীয় দৈনিক আরব টাইমস জানায়, বিচারকমণ্ডলী প্রবাসীদের সাক্ষ্য শুনেছেন। প্রতি বছর কুয়েতে তাদের অবস্থান নবায়ন করে নিতে এসব সাক্ষীরা আসামিকে অর্থ প্রদান করতেন।
গত ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরেফ আবাসিক এলাকা থেকে দেশটির অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কাজী পাপুলকে গ্রেফতার করেছে। এরপর এমপি পাপুলকে আদালতে হাজির করলে জামিন আবেদন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
কুয়েতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘মানব ও অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, এমন কয়েক শ ব্যক্তির তালিকা করেছে কুয়েত সরকার। সেই তালিকা ধরেই সম্প্রতি বিতর্কিত শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে দেশটির গোয়েন্দা বিভাগ। সেই অভিযানেই গ্রেফতার হন এমপি পাপুল।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দৈনিক আরব টাইমস, আরবি দৈনিক আল কাবাস, কুয়েতি টাইমসসহ কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশি এই এমপির বিরুদ্ধে মানবপাচারে জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। কুয়েত পুলিশের বরাত দিয়ে আল কাবাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, চক্রটি ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে কুয়েতে নিয়েছিল। এমপি পাপুল তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি নিয়েছেন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। এভাবে তিনি পাঁচ কোটি কুয়েতি দিনার পকেটে পোরেন, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, পাপুল ১৯৯২ সালে শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে যান বড় ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরে। সেই ব্যক্তিই আজ দেশে দুটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। কুয়েতেও রয়েছে তাঁর একাধিক প্রতিষ্ঠান। আলিশান বাড়ি-গাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি।
পাপুলের প্রভাব-প্রতিপত্তি শুধু বিত্তে থেমে থাকেনি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থেকেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা আকস্মিকভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনই হয়েছেন সংসদ সদস্য। নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। আর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম কুমিল্লা থেকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হয়েছেন।
আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধানও চলছে। দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের তত্ত্বাবধানে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। দুদকে আসা অভিযোগপত্রে এমপি কাজী শহিদের বিরুদ্ধে কমিশন খেয়ে ব্যাংকঋণ বরাদ্দসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা পাপুল ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট শরিক জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে মনোনয়ন দেয়। আর পাপুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মোহাম্মদ নোমান নাটকীয়ভাবে গাঢাকা দেন। সে সময় অভিযোগ ওঠে, পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে নোমানকে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে দেন পাপুল। পরে ভোটে জিতে এমপি হয়ে যান পাপুল। পরবর্তী সময়ে স্ত্রী সেলিনা ইসলামের জন্যও বাগিয়ে নেন কুমিল্লার সংরক্ষিত আসনের এমপির পদ। সেলিনা কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা।
অভিযোগ রয়েছে, পাপুল এমপি ব্যবসার আড়ালে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে দেশ থেকে ২৮০ কোটি টাকা হুন্ডি ও বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করেন। বাকি টাকা তাঁর শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং জেডডাব্লিউ লীলাবালি নামক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করেন।
গুলশান-১ নম্বরের ১৬ নম্বর সড়কে গাউসিয়া ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পে মেয়ে ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট, গুলশান-২ নম্বরে পিংক সিটির পেছনে গাউসিয়া ইসলামিয়া প্রকল্পে স্ত্রীর নামে ৯ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, স্ত্রী ও নিজের নামে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৯১ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে পাপুলের। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার্স বন্ড ও মেয়ের নামে ২০ কোটি টাকার বন্ড রয়েছে। একটি ব্যাংকে নিজ নামে ৪০ কোটি, মেয়ের নামে ১০ কোটি ও স্ত্রীর নামে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। রাজধানীর এক আবাসিক এলাকায় স্ত্রীর নামে রয়েছে ছয় তলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি।
যেভাবে এমপি হলেন কাজী পাপুল ও তার স্ত্রী: দীর্ঘ প্রবাসজীবন কাটিয়ে নির্বাচনের মাত্র বছর দুয়েক আগে দেশে ফেরেন পাপুল।কী রাজনৈতিক অঙ্গন, কী এলাকা- কোথাও তেমন পরিচিতি ছিল না তাঁর। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হয়ে গেলেন তিনি। শুধু তাই নয়, তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলামও সংরক্ষিত (নারী) আসনে এমপি হয়ে গেলেন।রাজনীতিতে এসেই তারা বাজিমাত করলেন।
জানা যায়, ২০১৬ সালের শেষের দিকে কুয়েত প্রবাসী কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুল লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। ওই সময়ে তিনি রায়পুর পৌর শহরের আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাকি বিল্লাহের হাত ধরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সভায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করাসহ মানব সেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার ঘোষণা দেন তিনি। পরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দিরসহ সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে ব্যাপক আর্থিক অনুদান দেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে সর্বমহলে দানবীর ও ধনকুবের হিসেবে পরিচিতি করাতে সক্ষম হন। তিনি বিভিন্ন সভায় নিজেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মালিক দাবি করে বলেন, নিতে আসিনি মানব কল্যাণে দিতে এসেছি। তার সহধর্মিণীও নিজের স্বামীর গুণের কথা তুলে ধরেন। এক সভায় তিনি বলেন সাগরের পানি শুকিয়ে গেলেও পাপুলের টাকা শেষ হবে না। এরপর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চান পাপুল। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। এ আসনে মহাজোট থেকে মনোনয়ন পাওয়া জাতীয় পার্টির তৎকালীন এমপি হঠাৎ আত্মগোপনে চলে যান। তখন অভিযোগ ওঠে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান নোমান। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট হয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করেন পাপুল। সংরক্ষিত (নারী) আসনে স্বতন্ত্র এমপিদের গ্রুপ থেকে শহীদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। এ কোটায় তাঁরও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। সেলিনার পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায়। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।(9-6-2020)
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |