উজ্জ্বল রায়, নড়াইল থেকে:- নড়াইলের দিলীপ স্যার বিনা পারিশ্রমিকে সকাল-বিকেল এভাবে খেলাধুলার চর্চা করান নড়াইলের লোহাগড়া পাইলট স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক দিলীপ চক্রবর্ত্তী। ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশসেরা বিদ্যালয় লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। ক্রীড়াক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য পুরোনো। ১৯২০ সালে লোহাগড়া ফুটবল দল গঠন হয়। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাশিনাথ সরকার। ১৯৩৬ সালে মহকুমা প্রশাসক আন্তবিদ্যালয় ক্রীড়া চালু করেন। গঠন করা হয় আন্তবিদ্যালয় ক্রীড়া সমিতি। এর সম্পাদক হন লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এরপর থেকে ক্রীড়ায় এগোতে থাকে বিদ্যালয়টি। ২০০২ সালে বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন দিলীপ চক্রবর্তী। তাঁর হাত ধরেই ক্রীড়ায় ধারাবাহিক বিস্ময়কর সাফল্য আসে। এ পর্যন্ত টানা ১২ বার শীতকালীন জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অ্যাথলেটিকসে দেশসেরা হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যালয় চত্বরের তিন পাশ ঘেরা দ্বিতল ভবন। দক্ষিণে বিশাল দর্শনীয় শহীদ মিনার। নানা গাছে ঘেরা চত্বরের চারপাশ। আছে বিশাল উন্মুক্ত মঞ্চ। এ অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদারের প্রচেষ্টায় ১৯০২ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ৭৬৯ জন ছাত্রী। শিক্ষক রয়েছেন ২৮ জন। অ্যাথলেটিকসে গত ১২ বছর ধরে দেশের মধ্যে একক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণপদক পেয়েছে বিদ্যালয়টি। এ ছাড়া জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ২০০৫ সাল থেকে স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ বিদ্যালয়ে আছে পুরুষ ও নারী হকি দল। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা হকি দলের খেলোয়াড় এ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাদিয়া খানম, নমিতা কর্মকার ও রিতু খানম। রিতু খানম জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন। নমিতা কর্মকর বর্তমানে লোহাগড়া এম এ হক কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এখানো সে দিলীপ চক্রবর্তীর কাছে নিয়মিত চর্চা করছে। নমিতা অ্যাথলেটিকসে এ পর্যন্ত ১৩টি স্বর্ণপদক পেয়েছে। ’নমিতা বলেন, ‘দিলীপ স্যারের চেষ্টা ও অনুপ্রেরণা এবং আমাদের ইচ্ছাশক্তি রয়েছে এ সাফল্যের পেছনে। দিলীপ স্যার বিনা পারিশ্রমিকে সকাল-বিকেল এভাবে আমাদের চর্চা করান।’আন্তবিদ্যালয় মহিলা হকি টুর্নামেন্টে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে নড়াইল জেলা হকি দল দেশে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০২০ সালে হয়েছে রানার্সআপ। এর সব খেলোয়াড় এ বিদ্যালয়ের। আন্তজেলা মহিলা হ্যান্ডবল লীগে নড়াইল জেলা দল ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এর ১২ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ৮ জনই এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত পাঁচ বছর ধরে এসএসসিতে শতভাগ পাস করছে বিদ্যালয়টিতে। গতবার ৮১ জন পেয়েছে জিপিএ-৫। জেলা ও উপজেলা স্কাউটে বরাবরই সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয় চত্বরে আছে উন্মুক্ত মঞ্চ। এই মঞ্চ ঘিরে লোহাগড়ায় তৈরি হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক বলয়। বিদ্যালয়ে আছে সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য, বিতর্ক ও নাটকের দল। দলগুলো আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকে। ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্যের শীর্ষে যারা, তার বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। স্কুল থেকে তাঁদের বেতন নেওয়া হয় না। খেলার প্রশিক্ষণও দিলীপ চক্রবর্তী দেন বিনা মূল্যে। ক্রীড়ায় সব শাখার পেছনের কান্ডারির নাম দিলীপ চক্রবর্তী।’-বলছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এস এম হায়াতুজ্জামান। খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক দিলীপ নিজেও পেয়েছেন স্বীকৃতি। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন ২০১৮ সালে সেরা সংগঠকের পুরস্কার দিয়েছে। আরটিভি দিয়েছে অ্যাথলেট ও খেলোয়াড় তৈরির কারিগর প্রেরণা পদক। নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন দিয়েছে বিশেষ ক্রীড়া সম্মাননা। উপজেলা স্কাউটসের টানা ১৭ বছর ধরে কোষাধ্যক্ষ। ফুটবলের রেফারি হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় অংশ নেন। দিলীপ বলেন, ‘স্বপ্ন দেখি, আন্তর্জাতিক সব আসরে আমার ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল নক্ষত্র হবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।’নড়াইল জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, লোহাগড়া পাইলট স্কুল ক্রীড়া ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে আর দিলীপ চক্রবর্ত্তী হলো এর সারথি।