পাকা সড়কের বিভিন্ন স্থানে পিচ-খোয়া উঠে গেছে। ছোট-বড় অসংখ্য খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে পানি জমে যায়। বছরের পর বছর এসব সড়কের ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন।
সড়ক ব্যবস্থার এমন দশায় দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। উৎপাদিত ফসল ঠিকঠাক বাজারজাত করতে পারছেন না কৃষকরা। আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে জেলার উন্নয়নে মূল প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে এলজিইডির সড়ক।
এলাকাবাসির অভিযোগ, শুধু কাঁচা সড়ক নয়, জেলার পাকা সড়কগুলোও বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খানাখন্দে ভরে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে এগুলোর সংস্কার করা হয় না। ফলে খাতা কলমে যেটুকু সড়ক পাকা রয়েছে তার ৫০ শতাংশই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আজম শেখ, ইলিয়াস খান, সাহিন সরদারসহ আরও কয়েকজন জানান, বর্ষা মৌসুমে বেশিরভাগ সড়কে হাঁটু সমান কাদা হয়ে যায়। বছরে ৬ মাসেরও বেশি সময় এসব রাস্তা দিয়ে কোন যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এমনকি পায়ে হেঁটেও চলাচল করা যায় না। ঐ সময় কৃষকরা উৎপাদিত ফসল হাট-বাজারে নিতে পারেন না। ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে পারেন না। ফলে সবজিসহ অনেক বিভিন্ন প্রকার ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এতে কৃষকেরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সরেজমিনে জেলা সদরের তুলারামপুর-শেখ হাটি, দত্তপাড়া-চালিতেতলা, লোহাগড়া উপজেলার নলদী-লাহুড়িয়া, মল্লিকপুর-ইতনা এবং কালিয়া উপজেলার কয়েকটি সড়কে ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তার অধিকাংশ স্থানে পিচ ও খোয়া উঠে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে বিভিন্ন যানবাহন।
স্থানীয় বাসিন্দা রহমত আলীসহ অনেকে জানান, জেলার সীমান্তবর্তী সড়ক দিয়ে প্রতিদিন মাগুরা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও নড়াইল জেলার অসংখ্য মানুষ চলাচল করেন। জেলার উৎপাদিত ফসলের একটা বড় অংশ এই সব রাস্তা দিয়েই বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করা হয়। গ্রামীণ এসব সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে জেলার সবচেয়ে বড় বড় কয়েকটি বাণিজ্যিক বাজার।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মসলেম ঠাকুর, রহমতসহ আরও কয়েকজন জানান, এসব গ্রামীণ সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে লাহুড়িয়া, মাকড়াইল, বাতাসি, মন্ডলবাগ, শিয়েরবর, মানিকগঞ্জ, আড়িয়ালা, মহাজন, বড়দিয়াসহ বিভিন্ন বাজার। গ্রামীণ এসব বাজারে পণ্য পরিবহনে প্রতিনিয়নত মালবোঝাই ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। সড়কের দূরবস্থা থাকায় অনেক সময় পণ্য পরিবহনে অনেক বেশি ভাড়া দিতে হয়।
কলিগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী কাদু মিয়া জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে জেলার উৎপাদিত ফসল এসব বাজার থেকে কিনে গ্রামীণ সড়ক দিয়ে পরিবহন করেন। লোহাগড়া উপজেলার শেষ প্রান্ত লাহুড়িয়া বাজার। এ বাজার থেকে মাগুরায় সরাসরি পণ্যবাহী যানবাহনসহ অসংখ্য গাড়িঘোড়া চলাচল করে। লাহুড়িয়া বাজার থেকে লাহুড়িয়া-মিঠাপুর সড়ক দিয়ে নড়াইল শহর দিয়ে ঢাকায় পণ্যবাহী যানবহন চলাচল করে।
জয়পুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আকতার হোসেন জানান, তার ইউনিয়নের বেশিরভাগ রাস্তারই বেহাল অবস্থা। দ্রুত এ সকল রাস্তা চলাচলের উপযোগী করার দাবি জানান তিনি।
নড়াইল সদর উপজেলার পেড়লী ও চাকই গ্রামের চিংড়ি চাষি জিরু ও আলম শেখ জানান, এলাকায় শত শত মানুষ চিংড়ি চাষ করেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চিংড়ির চাষ খুব ভালো হয়। সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে এলাকায় কোন যানবাহন ঢুকতে পারে না। উৎপাদিত মাছ শহরে সঠিক সময়ে পৌঁছানো যায় না। ফলে শহর থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে তাদেরকে জিম্মি থাকতে হয়। ব্যবসায়ীরা কম দামে তাদের মাছ কেনেন। এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, নড়াইল অন্যতম কৃষিপ্রধান জেলা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করেন। জেলায় উৎপাদিত ধান, চাল, পাট, পাটকাঠি, নারিকেল, পান, সুপারি, বিভিন্ন প্রকার সবজি, সাদা মাছ, চিংড়ি মাছ, বাঁশসহ বিভিন্ন প্রকার কৃষিপণ্য চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলাতে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ ও সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে পারছে না কৃষকরা। মিলছে না কাঙ্ক্ষিত মূল্য।নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শাহানারা বেগম জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে এলাকার দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব। এলাকার উন্নয় করতে হলে গ্রামীণ সড়কগুলোর দ্রুত উন্নয়ন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়াও আগামী বাজেটে সড়ক উন্নয়নে বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করার দাবি করেন এই অর্থনীতিবিদ।
নড়াইল জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুয়াজেত হোসেন জানান, জেলায় যে বরাদ্দ পাওয়া যায় সড়কগুলোর গুরুত্ব অনুযায়ী কাজ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মধ্যে বেশির ভাগ সড়কই পাকা। নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজার আন্তরিক চেষ্টায় ‘নড়াইল উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নড়াইলবাসির চাহিদা অনুযায়ী সড়কগুলো পাকা করা হবে।