আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৬:২৯

শিরোনাম :

‘বিগত ১৫ বছরের তথ্য নিয়ে নানা বিভ্রাট রয়েছে, তথ্য লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে:অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ‘চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে ,সেই কারণে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি’র সমমনা দল ও জোট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুকে যে পোস্ট দিয়েছিলেন তার ‘তীব্র প্রতিবাদ’ জানিয়েছে ভারত বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ আর নেই(ইন্না লিল্লাহি……রাজিউন) প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ খেতাবে ভূষিত করেছে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার বিষয়ে আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে:ড. বদিউল আলম মজুমদার নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মানস ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট, ২০২১ ১২:০৯ অপরাহ্ণ

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান:- বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, শেষ পর্যন্ত জাতির জনকে পরিণত হওয়া, পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এগুলো নিয়ে এর মধ্যেই অনেকে প্রবন্ধ ও বই লেখা হয়েছে। এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল ফিলোসফি বা রাজনৈতিক দর্শন এবং সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা। সৃষ্টিকর্তা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, আর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র, মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু সৃষ্টি করেছে সবচেয়ে বড় সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যদি না থাকত আমাদের যা কিছু অর্জন বিজ্ঞান, সমাজ, ধর্ম, উদ্ভাবন, সবই ভূলুণ্ঠিত হতো। রাষ্ট্র কাঠামো আছে বলেই সবগুলো রক্ষিত হচ্ছে। যেটা আজকের বাংলাদেশ, এই ভূখ-ে বিভিন্ন রকমের রাজা ছিল, সামন্তবাদী জমিদার ছিল, ভূঁইয়ারা ছিল, এমন বহু কিছু ছিল; কিন্তু এই অঞ্চল কখনও একটা আধুনিক রাষ্ট্র হবে সেটা কখনও কেউ চিন্তা করেনি।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা তিনি কীভাবে করলেন সেটা শুধু তার রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যায়। ইবনে খালদুন, হিস্টোরিগ্রাফির জনক ১৩৭৭ সালে তার বিখ্যাত বই মোকাদ্দিমায় লিখে গেছেন, যে প্রেক্ষাপটে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে এই প্রেক্ষাপট কেউ বিস্তারিত না জেনে কোনো কিছু উপস্থাপন করলে, ওই আলোচনাটা পূর্ণাঙ্গ হয় না (কযধষফঁহ, ১৯৬২)। বাংলাদেশ নামক এই যে রাষ্ট্রটার আমরা মালিক সেটা কীভাবে আমরা পেলাম, কী অবস্থায় এটা তৈরি হলো এর প্রেক্ষাপটটা একটু বলি। প্রথমে আমি অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। কারণ অবিশ্বাস হচ্ছে, কোনো কিছু শুরু করার জন্য ভালো কাজ। এটা আবার আমি বলছি না, রেনে দেকার্তে, ফরাসি দার্শনিক ১৬৩৭ সালে ‘উরংপড়ঁৎংব ড়হ গবঃযড়ফ’ বইয়ে বলে গেছেন। কোনো কিছু শুরু করার সময় অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে হয়। সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে আমি একটা অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। আসলে ‘আমরা কখনোই অসাম্প্রদায়িক ছিলাম না।’

আরেকটা প্রচলিত বিশ্বাস, আমরা প্রায়ই বলি স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জাতি ১৯৭১ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম, এটাও আমি বিশ্বাস করি না। আসলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হইনি। প্রথম প্রমাণ হচ্ছে, ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে মিটিং হয়েছিল এই যে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রটা হলো এটার রাষ্ট্রভাষা কী হবে? সেখানে যত বাংলা ভাষাভাষী এমসিএ ছিল, কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া সবাই বলেছিল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যে, এদেশে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যাবে না। মাত্র ১০ জন বুদ্ধিজীবী এটার প্রতিবাদ করেছিল, এটা বড় অন্যায়। পরদিন পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১১০ জন বুদ্ধিজীবী।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন সব কিছুকে নিয়ে ’৭১-এ যখন মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ লোকের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্রটা তৈরি করলাম, এটাকে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত করা হয়। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের যত অনুষঙ্গ ছিল, সব ফিরে এলো। একজনের পর একজন জেনারেল এলো, আমাদের পুরো গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করা হলো। আমরা ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ ছিলাম ২০-২২ বছর। আমাদের প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে ছিল, তথাকথিত হ্যাঁ অথবা না ভোটের মাধ্যমেই বৈধতা কেড়েছিল। তথাকথিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে থেকেই নির্বাচিত হতো। এরপর আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ক্যান্টনমেন্টে থাকত। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী ক্যান্টনমেন্টে থাকত। প্রেসিডেন্ট বদল হলো, ‘শর্ষীনা-সানগ্লাস-সাফারি’ থেকে ‘আটরশি-হেলিকপ্টার-মেরীর’ দিকে চলে গেল। জেনারেল শুধু বদল হলো। একই বলয়ের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সার্বভৌমত্ব আটকা পড়ল। আমাদের যা কিছু আছে অর্থাৎ বাঙালির যা কিছু ছিল সবটাই ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করা হলো। আমি তো মনে করি বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে এই দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, ১৯৭৫-এর পর সে রাষ্ট্রটি ছিল না। এটা কেবল পুনরুদ্ধার করা হয় ১৯৯৬ সালে, পাকিস্তান থেকে আবার বাংলাদেশ। যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, সেটার পুনর্জন্ম হয়। আমরা এখন একটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে যেরকম ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় তা হলো সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা। আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি, সেটা বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের কথা। গণতন্ত্রের একটা সংজ্ঞা আছে যেটা আব্রাহাম লিংকন দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যদি নেন তাহলে কিন্তু গণতন্ত্রের ভেতরে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা যাবে। গণতন্ত্রই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা এটা বলা যাবে না। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর নেই বলেই আমরা বলি এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা। গণতন্ত্র বলতেই বোঝানো হয় সবাই যেটা বলবে অথবা মেজোরিটি লোক যেটা বলবে এটাই মেনে নেওয়া। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, একজনও যদি ন্যায্য কথা বলেন সেটা মেনে নেওয়াই হচ্ছে গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘…যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ তাহলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা কী হওয়া উচিত? গণতন্ত্র বলতে বঙ্গবন্ধু কী বোঝালেন? আমরা সনাতনভাবে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝি, সবাই মিলে বা বেশিরভাগ লোকে যা ভালো বুঝি, সেটাই গণতন্ত্র। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা আছে, সবাই মিলে ভুল করছে। অধিকাংশ লোক বা সব লোক যেটা বলছে সেটাই সত্য? মানুষের মধ্যে সবাই মিলে যা বলে এটাকে সত্য হিসেবে ধরে নেওয়ার একটা প্রবণতা আদিকাল থেকে ছিল।

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সুসংহত করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়েই। আবুল মনসুর আহমেদ ও আতাউর রহমান খান মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতাকে আমরা সেই মতাদর্শিক বিষয়ে কলম ধরতে দেখেছি (আহাদ, ১৯৮৪)। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পূর্ব-বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিভেদে রাজি ছিলেন না। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালির সমর্থন পেতে কখনও হিন্দু বাঙালির বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি ও সংঘাতের রাজনীতি করেননি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে যুক্ত করেন। বাঙালির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র সফল নেতা, যিনি হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে একত্রিত করেছেন (খান, ২০১৪)। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিমদের সমর্থন ছিল না, আবার উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতারাও মুসলিমদের এসব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যুক্ত হননি। বঙ্গবন্ধু এমনকি বাঙালিদের অন্য কোনো জাতির বিরুদ্ধে, যেমন বিহারিদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণে প্ররোচণা দেননি। বরং তাদের নিরাপত্তা দিতে ৭ মার্চের ভাষণে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ তিনি সব জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান এবং সব নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাস করতেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে সাম্যের কথাটা এসেছিল সমাজতন্ত্র হিসেবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদী অর্থনীতি দর্শনগতভাবেই মানুষে মানুষে বিভেদ উদ্রেককারী। আর এজন্য ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু বলছেন :

‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিােবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা (রহমান, ২০১২: পৃ. ২৩৪)।’

তখন সমাজতন্ত্র শব্দটার জয়জয়কার। সমাজতন্ত্র একটা রোমান্টিক শব্দ। শুধু মনোজগতে নয়, ব্যক্তিজীবনেও বঙ্গবন্ধু অসাম্য দূর করার, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে কাজ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ায় ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা দেখি, দাওয়ালদের (যারা ধান মৌসুমে দিনমজুর হিসেবে ধান কাটে) যৌক্তিক দাবি অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান সরকার যখন দাওয়ালদের ধান কেড়ে নেয় তখন তরুণ মুজিব প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন (রহমান, ২০১২: পৃ. ১০৪)। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন বৈষম্যহীনতার চর্চার কথা। কারাগারে তিনি সবার সঙ্গে একসঙ্গে খেতেন, যেমন ব্যবস্থা ছিল তার নিজ বাড়িতে :

‘আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম। …আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদ ছিল, তখন জমিদার, তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ সামন্ততন্ত্রের কবরের ওপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ (রহমান, ২০১৭: পৃ. ১১)।’

যেটা বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তার থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি আমরা, আমার কাছে মনে হয়Ñ আজকে যেটা আমরা বলি এবং শুনি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে ২০৩০ সালে, মোটামুটি ২০৪০ সালে আমরা ধনী বাংলাদেশ হয়ে যাব, সেটাও ডলারের হিসাবে। কত ডলার হলে নিম্ন আয়ের, কত ডলার হলে মধ্যম আয়, কত ডলার হলে ধনী তা বিশ^ব্যাংক ঠিক করে দিয়েছে। ৫ হাজার ডলার হলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হবো, ১২ হাজার ডলার হলে ধনী হবো ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমাদের সব রাস্তা দোতলা হবে, ফ্লাইওভার থাকবে সর্বত্র, দোতলা তিনতলা সব বিল্ডিং উঁচু হয়ে যাবে। আমার মনে হয় না জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ এরকম ছিল। জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা সেটা ছিল সাম্যের বাংলাদেশ। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রে মেহনতি মানুষের কল্যাণ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব তা বঙ্গবন্ধুর মনে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে জায়গা করে নেয়। সমাজতন্ত্র বলতে তিনি প্রধানত শোষণমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটা ব্যবস্থার কথা ভাবতেন। ১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রের পার্থক্য তিনি উপলব্ধি করেন। তা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ লিখেছেন : ‘তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ ও এ দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন (রহমান, ২০১২: পৃ. ৩৩৪)।’ বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, শোষণমুক্তি এবং বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। চীনে গিয়ে তার এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। তিনি দেখতে পান, কীভাবে চীনে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে, ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে ‘আজ চীন দেশ কৃষক-মজুরের দেশ। শোষক শ্রেণি শেষ হয়ে গেছে।’ নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে রাষ্ট্র কীভাবে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রাপ্তির মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করেছে (পৃ. ২৩০)। অনেক স্বপ্নই আমরা এখন দেখি, বঙ্গবন্ধু এত স্বপ্ন দেখেননি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল মিলেমিশে বাংলাদেশ ধনী-গরিব, পুরুষ-মহিলা, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই মিলে সাম্যের বাংলাদেশ। সবাই মিলেমিশে থাকব। আমরা অনেক উন্নতি করলাম। আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। জাতির জনকের যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, সাম্যের বাংলাদেশ সেটা কোথায়। বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে যেখানে একপর্যায়ে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে, কয়েক বছর যাবৎ গিনি সহগে আমরা দশমিক ৫-এর সামান্য থেকে নিচে আছি। অরাজকতার বা চরম বৈষম্যের মাত্রা দশমিক ৫-এর বেশি দূরে নেই। বৈষম্যের কারণে অর্থনীতিতে একটা অরাজকতা তৈরি হয়, সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ক্যাসিনোতে দেখলাম যারা নিঃস্ব হয়ে যায় তাদেরকে ক্যাসিনোর মালিকরা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমরাও যদি এরকম ধনী হয়ে গেলাম, ধনী হতে গিয়ে সব ক্যাসিনোর হাতে চলে গেল, আমরা শুধু খেয়ে বেঁচে থাকলাম। আমার মনে হয় না যে, জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা এটা ছিল। আর আমরা বলছি যে আয় বাড়ছে, বলছি ডলারের হিসাবে মধ্যম আয়ের দেশ, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ইত্যাদি। ইরাক, সিরিয়া, মিশর, অনেক আগেই ডলারের হিসাবে মধ্যম আয়ের দেশ ছিল। কিন্তু সেই দেশগুলো সেভাবে টিকে নেই। না টেকার কারণ হচ্ছে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেই স্বপ্ন নিয়ে আমরা বাংলাদেশ করলাম যেটাকে বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনা থেকেই যদি দূরে সরে যাই সেটা দিয়ে হয়তো উন্নয়ন হবে; কিন্তু টেকসই হবে না। যেটা ইরাক, সিরিয়া, মিশরের ক্ষেত্রে হয়েছে। অতএব, আমি আবারও বলছি জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা বলতে শুধু ধনী বাংলাদেশ নয়। যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে জাতির জনক একটা স্বাধীন সার্বভৌম আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র সৃষ্টি করলেন, সেটা ছিল সাম্যের বাংলাদেশ, অসাম্প্রাদায়িক বাংলাদেশ, মানুষে মানুষে ভালোবাসার বাংলাদেশ। সেখান থেকে কোনোভাবে আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না এবং সেটাই আমাদের অর্জন করতে হবে। দেশের শত্রুরা যারা একেবারে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই সব কিছুর বিরোধিতা করে আসছে, তারা কখনোই নিষ্ক্রিয় হয় না। মাঝেমধ্যে দুর্বল হয়, এখানে সেখানে লুকায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে এই অপশক্তি কখনোই নিঃশেষ হয় না। নিঃসন্দেহে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধই সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। বাঙালি জাতি তার দীর্ঘদিনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিজেদের জন্য একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি কী হবে? ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে জেনারেলরা ট্যাঙ্কের বলে সংবিধান ইচ্ছা মতো স্থগিত করেছে, সংশোধন করেছে। বাংলাদেশকে বানিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাদেশকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে, যারা বাংলাদেশের জন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দুটোই অস্বীকার করে। দেশের ও আশপাশের মৌলবাদী আগ্রাসন রোধে এবং নিকৃষ্টতম চলমান লুণ্ঠন ও দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দূর করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়তে আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার কাছে ফিরতে হবে; বাংলাদেশকে তার দার্শনিক ভিত্তি বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজকে রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।  লেখক:  অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়।

Please follow and like us:
error20
fb-share-icon
fb-share-icon20

লেখকের কলাম

আরও পড়ুন

গত ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ

  • আর্কাইভ

    আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসররা দূর্নীতি করে সেকেন্ড হোম বানিয়ে পালিয়ে আছে : আমিনুল হক

    ‘বিগত ১৫ বছরের তথ্য নিয়ে নানা বিভ্রাট রয়েছে, তথ্য লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে:অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

    ‘চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে ,সেই কারণে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী

    “প্রথম বাংলাদেশ-আমার শেষ বাংলাদেশ”

    আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি’র সমমনা দল ও জোট

    কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে মাদক ব্যবসায়ী ৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ১ জন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি গ্রেফতার

    কুষ্টিয়ায় চেয়ারম্যান পুত্রের উপর জাসদ গণবাহিনীর হামলা

    আগামীকাল উত্তরা পর্ব থানা বিএনপির কর্মিসভা ও ৩১ দফার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে:প্রধান অতিথি থাকছেন আহ্বায়ক আমিনুল

    তারেক রহমানের নির্দেশনায় গাবতলী উপজেলার পদ্মপাড়া গ্রামে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্র বিতরণ করবে “কৃষিবিদবৃন্দ”

    ইতালিতে বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করলো কিশোরগঞ্জের সায়ক মিয়া

    টঙ্গীতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেইলি ব্রিজ ভেঙে পাথর বোঝাই ট্রাক তুরাগ নদীতে

    “যুবলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেনের সহযোগী সন্ত্রাসী পিস্তল জাহিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট”

    অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ ক্রিকেটের ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ নারী দল

    প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন

    উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুকে যে পোস্ট দিয়েছিলেন তার ‘তীব্র প্রতিবাদ’ জানিয়েছে ভারত

    “পতিত” আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসন রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে : আমিনুল হক

    চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান— রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শহীদ ও আহত পরিবারের পাশে তারেক রহমান

    উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ’র মৃত্যুতেবিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান-এর শোকবার্তা

    বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ আর নেই(ইন্না লিল্লাহি……রাজিউন)

    প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ খেতাবে ভূষিত করেছে

    আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে এবার শত শত কোটি ডলারের চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার

    পূর্বাচলে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী এক শিক্ষার্থী নিহত ,আহত আরও দুই শিক্ষার্থী

    ফিনল্যান্ড বিএনপির আয়োজনে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

    আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

    আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার বিষয়ে আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে:ড. বদিউল আলম মজুমদার

    নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত

    ফরিদগঞ্জে চাঁদপুর খবর’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

    আজকের যুদ্ধ স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার: তারেক রহমান

    দেশ ও জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে গতির ভূমিকা অপরিহার্য : বিএনপি নেতা জিল্লুর রহমান

    যুক্তরাজ্যের লেবার মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত ঘুষ নেয়ার অভিযোগ

    • Dhaka, Bangladesh
      রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
      SalatTime
      Fajr5:16 AM
      Sunrise6:37 AM
      Zuhr11:57 AM
      Asr2:57 PM
      Magrib5:17 PM
      Isha6:38 PM
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুল হাসান বাবলু
    ই-মেইলঃ dk.kamrul@gmail.com
    copyright @ বাংলাদেশ দিনকাল / বিডি দিনকাল ( www.bddinkal.com )
    বিডি দিনকাল মাল্টি মিডিয়া (প্রা:) লিমিটেড প্রতিষ্ঠান।