- প্রচ্ছদ
-
- রাজনীতি
- ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশী’ এবং জিয়াউর রহমান
‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশী’ এবং জিয়াউর রহমান
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ৫:১৭ অপরাহ্ণ
এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান:-‘বাংলাদেশ’ নামের দেশটার নাম শুনেছেন? ১৯৭১ সালে যখন স্বায়ত্বশাসনের দাবীদার আওয়ামী লীগের নেতারা হানাদার পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে কেউ আত্মসমর্পন করে পাকিস্তান তো কেউ ভারতে পালিয়েছিলেন, তখন সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভের সময় কোরান শপথ করে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকার শপথ ভঙ্গ করে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
হাল আমলে শুরু হওয়া ‘আমেরিকান আইডল’ বা ‘ইন্ডিয়ান আইডল’ এর দেখাদেখি বাংলাদেশেও ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ‘নতুন কুঁড়ি’র কথা মনে পড়ে? দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টেলিভিশন শিশু সাংষ্কৃতিক মেধা অনুসন্ধান প্রতিযোগিতা। সেটা শুরু করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
‘সবুজ বিপ্লব’ এর কথা মনে পড়ে? ১৯৭৪ সালে যে দেশে ৭ কোটি মানুষের খাবার উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি ১৯৮০ সালে সেই দেশটিই অভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে নেপালে চাল রফতানী করতে সক্ষম হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, এখন সেই দেশটিতেই ১৮ কোটি মানুষ দিব্যি খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। ওই সবুজ বিপ্লবেরও শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
‘জনশক্তি রফতানী’ কিভাবে শুরু হয়েছে জানেন? শহীদ জিয়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের কর্মক্ষম বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যেন দক্ষ জনশক্তি রফতানী করা যায় তার জন্য গড়ে তুলেছিলেন ‘যুব উন্নয়ন কেন্দ্র’সহ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ, জিয়ার প্রতিষ্ঠিত সাভারে ‘জাতীয় যুব উন্নয়ন কেন্দ্র’টির নাম বদলে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নির্লজ্জের মত শেখ হাসিনার নামে নামকরণ করেছে।
যুবকদের দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন যুব মন্ত্রনালয়, যুব উন্নয়ন কেন্দ্র, প্রতিটি মহকুমায় ন্যুনতম একটি করে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট। নারী-শিশুদের উন্নয়নে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়। শিশু একাডেমিও তাঁরই সৃষ্টি।
ভারতের পানি আগ্রাসনের কথা মাথায় রেখে জিয়াউর রহমান আরো চল্লিশ বছর আগে ‘খাল খনন’ কর্মসূচির মাধ্যমে জোতদারদের হাতে দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো পুন:খনন করে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, মাত্র দুই দশক আগে বিশ্বের পানি বিশেষজ্ঞরা ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে তার বদলে জলাধার নির্মান করে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন।
দেশের খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য তিনি পেট্রোবাংলার অধীনে অনুসন্ধান অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা (Exploration Directorate) করেন। সেই প্রতিষ্ঠান সিসমিক সার্ভের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন-শোর এবং অফ-শোর এ বিপুল পরিমান তেল-গ্যাস এর সন্ধান পায়। বাংলাদেশ তখন সেই সম্পদ উত্তোলনে কারিগরিভাবে সক্ষম ছিল না, তাই তিনি জাপানের কারিগরি সহায়তা নিয়ে সেই তেল-গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা করছিলেন। [১]
জিয়াউর রহমানই সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জীবিত এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরীর উদ্যোগ নেন, মুক্তিযুদ্ধের সকল দলিলপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, ‘স্বাধীনতা পদক’ এবং ‘একুশে পদক’ প্রবর্তন করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্প। এই শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং উন্নত বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোষাকের বাজার সৃষ্টিও প্রেসিডেন্ট জিয়ারই অবদান। ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে দেশের শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানী সহজ করাও ছিল জিয়াউর রহমানের অবদান।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ এই চার বছরে তিনি দেশের জন্য এমন আরো অনেক সাফল্য বয়ে এনেছিলেন: তিনি এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন (এমন কি শেখ মুজিব কর্তৃক নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগেরও পূনর্জন্ম দেন), সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন, জাপানকে হারিয়ে বাংলাদেশকে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য করেন। আন্তর্জাতিক কুটনীতিতে সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বোচ্চ অর্জন।
শহীদ জিয়াকে হত্যার পর ১৯৮১ সালে জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে তৎকালীন এমপি এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, “জিয়াউর রহমানের জানাজায় অংশ নিয়ে লাখ লাখ জনতার স্রোত তাতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। তার প্রতি গোটা বাংলাদেশের মানুষ তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছে। তাতে প্রমাণিত হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের মানুষের কত কাছাকাছি এবং প্রাণপ্রিয় ছিলেন। এটা বলতে কেউ কুণ্ঠাবোধ করলে মনে করব, তার মানসিক দৈন্য ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে।”
জিয়াউর রহমান কেন জনপ্রিয় ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বৃটিশ রাজ, পাকিস্তানী জান্তা এবং নিজের গড়া দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর বক্তব্য থেকে। অসুস্থ মওলানা ভাসানীকে হাসপাতালে দেখতে যান তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক আবদুল গফুরসহ কেউ কেউ। তখন জিয়াউর রহমানকে প্রকাশ্যেই সমর্থন দিচ্ছিলেন ভাসানী।
সেদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে অধ্যাপক গফুর বলেন, “আপনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। সেই আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায়। প্রকাশ্য জনসভায় আপনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের বলেছেন, দুর্নীতি করলে, জনগণের জন্য কাজ না করলে তোমাদের পিঠে চাবুক মারা হবে। আপনার নিজের দলের নেতাদেরও এমন কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, আর আজ আপনি জিয়ার প্রতি কেন সমর্থন দিচ্ছেন? জিয়ার প্রতি কেন আপনার এই দূর্বলতা?”
মওলানা ভাসানী বললেন, “আবদুল গফুর, আমি তোমার বাবার বয়সী। আমি আমার জীবনে তোমার চেয়ে বেশি সরকার ও বেশি নেতাদের দেখেছি। ব্রিটিশ আমলে দেখেছি, পাকিস্তান আমলে দেখেছি, বাংলাদেশ আমলেও দেখেছি। তুমি আমাকে একটা এক্সাম্পল দেখাও, কোন রাজনৈতিক নেতা কম-বেশি দুর্নীতি করে নাই বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় নাই এবং কোন নেতা স্বজনপ্রীতি করে নাই।”
অধ্যাপক গফুর চুপ করে রইলেন।
মওলানা বললেন, “এখন পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। কোনোরকম স্বজনপ্রীতিও তার মধ্যে নাই। তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে কেউ চেনে না। তাঁদেরকে সে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয় না। ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টে এ ধরণের শাসককে মানুষ পছন্দ করে। একজন সৎ শাসকের তো প্রশংসাই প্রাপ্য।”
– সৈয়দ আবুল মকসুদ / ভাসানী কাহিনী ॥ [আগামী প্রকাশনী – নভেম্বর, ২০১২ । পৃ: ৪৭-৪৮]
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ন ছিলেন তার প্রমান এই ছবিটি। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে তিনি যখন রাষ্ট্রীয় সফরে নেদারল্যান্ড গিয়েছিলেন, তখন নেদারল্যান্ডের রানী জুলিয়ানা তাঁর স্বামীকে নিয়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে অভ্যর্থনা জানাতে।
মাত্র চার বছরের রাজনীতি দিয়ে যে মানুষটি রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি বদলে দিয়েছেন এবং সেই বদলে দেয়া জাতীয়তাবাদী পরিচয় নিয়েই আজ শেখ হাসিনাকে বিদেশ ভ্রমন করতে হচ্ছে (তার পাসপোর্টেও লেখা Nationality/জাতীয়তা: বাংলাদেশী); মাত্র চার বছরের রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – B.N.P দিয়ে যিনি মৃত্যুর ৩৬ বছর পরও ৫০/৬০ বছরের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের প্রতিষ্ঠিত পৌনে শতাব্দির পুরাতন রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবেলা করে যাচ্ছেন; তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা বা তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা রটনা করে তাঁকে খাটো করার চেষ্টা করা যে নিরেট মূর্খতা সেটা সামান্য বোধবুদ্ধি আছে এমন যে কোন মানুষ বুঝতে পারবেন। কেবল বুঝতে পারবেন না কিছু গণ্ডমূর্খ গোঁয়াড়।
যে ব্যাটসম্যান ইতিমধ্যেই সেঞ্চুরী করে ফেলেছে, তাকে পরাজিত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি রান করা; তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করলে বা তাকে ধরে পেটালে ঐ সেঞ্চুরী রেকর্ড বুক থেকে মুছে যায় না। এই বাস্তবতা গাণ্ডুদের কে বোঝাবে?
(লেখক-এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি।)
Please follow and like us:
20 20