আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৬:১৩
বিডি দিনকাল ডেস্ক :- মনে হলো, আমাকে জেরা করা লোকগুলো ছিল বয়সে নিতান্তই তরুণ, তাদের বয়স সম্ভবত ৩০-৩৫ বছর বয়সের বেশি হবে না। তার মানে তাদের জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অনেক পরে। কিন্তু অন্ততপক্ষে তারা নিশ্চয়ই বইয়ে পড়েছে কীভাবে পুলিশের গুলিতে বরকত, সালাম, জব্বার, রফিকের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তাদের ওই তথ্যগুলো জানা উচিত ছিল যে, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের তাজা রক্ত ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ প্রথম তাদের আত্মপরিচয় উপলব্ধি করেছিল। সময়ের আবর্তনে দেশের প্রতিটি যুবক-যুবতী, ছাত্র-জনতা পরিণত হয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশে। যতই তাদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ, পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধস্পৃহা ততই তীব্রতর হয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালে লাহোরে পেশকৃত শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি রচনা করেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহিতার ১১ মাসব্যাপী পরিচালিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ‘বিনা শর্তে’ প্রত্যাহার করতে হয়।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের পতন ঘটে। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের বিজয়কে অস্বীকার যখন করা হলো এবং সামরিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট ছিনিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা করা হলো, তেজোদীপ্ত জনগণ তার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। আর এসবই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
সম্ভবত তাদের সামরিক প্রশিক্ষকেরা এই তরুণ অফিসারদের এই মর্মে কোনো শিক্ষা দেননি যে, রাজনীতির ভিত্তিতেই একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় সূচিত হয়। আর রাজনীতিবিদেরাই হয় তার বাহক। রাষ্ট্র ও রাজনীতি একদিক দিয়ে প্রায় সমার্থক দুটি শব্দ। রাজনীতি ছাড়া একটি রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারে না। সমাজকে বিরাজনীতিকরণের উদ্যোগ নেয়ার অর্থ হলো রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটি একটি অবাস্তব অ্যান্টি-থিসিস। আধুনিক রাষ্ট্রের ক্রমোত্থানের প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে এই সত্যটিই বিমূর্ত হয়ে উঠতে দেখা গেছে। রাজনীতিবিদেরাই রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গোড়াপত্তন ঘটান। রাজনীতিবিদদের নিশ্চিহ্ন করার অর্থ হলো, এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ধ্বংস করে ফেলা। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রের শক্তির মূল আধার। একে ধ্বংস করে ফেলা হলো, প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে ফেলার নামান্তর।
এই রাষ্ট্র কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সে নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণের বিভিন্ন পর্যায়ে এই তরুণ সামরিক অফিসারদের স্পষ্ট কোনো ধারণা দেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। একটি রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে যে একটি ইতিহাস থাকে, সে সম্পর্কে বোধহয় তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান দেয়া হয়নি। এদের কেউই ভাষা আন্দোলনের মতো ব্যাপক আন্দোলনের রূপ দেখেনি। জনগণের দাবি আদায়ের জন্য তাদের কখনো কারাবরণ করতে হয়নি। ১৯৬৯ সালের মতো গণআন্দোলনের সঙ্গে তারা প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত নয়, কিংবা ১৯৭১ সালে কৃষক-ছাত্র-জনতার মতো তারা অস্ত্র হাতে রক্তক্ষয়ী দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়নি। সেই সময়গুলোতে সেনাবাহিনীর বর্তমান প্রধান স্বয়ং ছিলেন একজন যুবক এবং ১৯৭১ সালের অনেক পরে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বিশেষ একটি শর্ট কোর্সে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য স্বাধীনতা অর্জনে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। কাজেই রাজনীতিবিদেরা দেশের জন্য কিছুই করেনি এমন আপ্তবাক্য তাদের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু ছিল না।
আমার তখন মনে পড়ে ১৯৫৫ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারির রাত দুটোর সময়ে নিদারুণ শৈত্যপ্রবাহ কবলিত অন্ধকার এক রাতের কথা। ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে পালিত এই ভাষা দিবসে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন, কালোব্যাজ ধারণ এবং ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঘোষিত কর্মসূচি দমন করার জন্য সব রকমের জনসমাবেশ ও কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। এর আগে সংবিধানের ৯২ক ধারাবলে ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে মনোনীত গভর্নরের মাধ্যমে প্রদেশগুলো শাসন করার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হয়েছিল। এ সময় আমার বয়স ছিল বড়জোর ১৬ বা ১৭। মাত্র এক বছর আগে ম্যাট্রিক পাস করেছি। ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন সংলগ্ন ঢাকা কলেজের একজন ছাত্র তখন আমি। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রেল স্টেশনে আমরা জড়ো হলাম নির্ধারিত একটা চায়ের দোকানে। আমি এবং উচ্চতা ও শক্তিশালী দেহের জন্য মার্শাল হিসেবে পরিচিত সিরাজ উদ্দিন এবং নির্বাচিত কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা কলেজের নিচু দেয়াল টপকে চলে এলাম প্রধান বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি। মুহূর্তের মধ্যে টিকটিকির মতো পানির পাইপ বেয়ে উপরে উঠে গেল মার্শাল। তারপর কোমরে লুকানো কালো পতাকা উড়িয়ে দিলো জাতীয় পতাকা উড়ানোর লম্বা খুঁটিতে। এরপর নিজেদের কর্মতৎপরতায় অত্যন্ত সন্তুষ্টচিত্তে আমরা ফিরে এলাম রেলওয়ে স্টেশনের চায়ের দোকানে। মনের খুশিতে তিন কাপ চায়ের দাম ছয় পয়সার সঙ্গে আমরা আরো চার পয়সা বকশিশও দিয়ে ফেললাম চায়ের দোকানিকে। কিন্তু স্টেশন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা টের পেলাম যে, দুজন সাইকেল আরোহী ‘টিকটিকি’ সাইকেল না চালিয়ে হ্যান্ডেল ধরে হেঁটে হেঁটে আমাদের অনুসরণ করছে। শঙ্কিত হয়ে আমরা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলে তারাও আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের গতি বাড়িয়ে দিলো। দৌড় খেলার প্রতিযোগিতা। আমরা জোরে দৌড়াতে শুরু করলে ‘টিকটিকি’রা এক পর্যায়ে সাইকেলে উঠে আমাদের পেছনে পেছনে আসতে থাকে। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর আমরা পুরনো কলতাবাজারের পথে সরু এক গলিতে ঢুকে পড়ি। আর আমাদের চোখের সামনে দিয়ে তারা গলিপথ অতিক্রম করে সোজা রাস্তায় চলে গেল। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচি। আগের পরিকল্পনা মতো আমাদের সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল জীবনের একজন সহপাঠী ওয়াদুদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তার বাড়িতে। এখান থেকে তার বাড়ি মাত্র ১০০ গজ দূরে। সেখানেই আমাদের বাকি রাতের জন্য আশ্রয় নেয়ার কথা ছিল। আমরা ওই বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা জিপগাড়ি থামার শব্দ শুনতে পেলাম। তার সঙ্গে ভেসে এলো দ্রুত ওই বাড়ি ঘিরে ফেলার জন্য পুলিশের বুটের আওয়াজ। সিরাজ উদ্দিন এক মুহূর্তও দেরি না করে গিয়ে ঢুকলো রান্নাঘরে, একটা টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে ভেঙে ফেললো ছাদের কাছে লাগানো একটা ছোট্ট জানালার লোহার শিক। এরপর তিনজনে লাফ দিয়ে পার হয়ে চলে এলাম পাশের বিল্ডিংয়ে। সেটা ছিল জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের একটা হোস্টেল। তারা ছিল আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের আশ্রয়ে আমরা বাকি রাত সেখানে কাটাই।
(চলবে…)—-সূত্র মানবজমিন
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |