আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৬:০০
মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ:-মনার সঙ্গে হঠাৎ দেখা বেলস পার্কের পশ্চিম কোণে। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে। চুলে তার পাক ধরে গেছে। পাশেই বসা পাঁচ বছরের এক খোকা। চোখ তার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। মনাকে পরিচয় করিয়ে না দিলে চিনতে সুবিধে হবে না।
মনে আছে ছোটবেলার সেই ছড়ার কথা? আহসান হাবীবের লেখা ‘ইচ্ছা’। অ্যান্টেনার কাছাকাছি আসছে। নেটওয়ার্ক আইসি দুর্বল হওয়াতে পুরোপুরি ক্যাচ করতে পারছেন না অনেকেই। ওই যে ‘মনারে মনা কোথায় যাস’?
সেই মনার সঙ্গে দেখা। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই তেলেবেগুনে চটে গেলেন। বিরক্তিভরা কণ্ঠে বললেন, ‘না রে বাপু আমি এখন ঘাসটাস কাটি না। ঘাস বেচে জাল কিনি না। মাছ বেচতে হাটে যাই না’।
গড় গড় করে অনেক কথা বলে গেলেন। বুঝতে পারলাম এসব প্রশ্ন করে করে মানুষ তার মন বিষিয়ে তুলেছে। আমি তার কাছে বসে পিঠে হাত দিয়ে বললাম, আমার অনেক দিনের শখ আপনার সেই ঘাস কাটার কাহিনি জানব। প্লিজ একটু বলবেন?
মনা আহসান হাবীবের ওপর রাগ ঝাড়ল অনেকক্ষণ। উনি আমায় এত বড় বিপদে ফেলেছেন। জানেন আমি কী মুশকিলে পড়েছিলাম। উনি তো ছড়া লিখে দিয়েই খালাস। আর আমার কী দশা হয়েছিল কেউ খোঁজ নিয়েছেন?
মনা রাগত কণ্ঠে বলে যেতে লাগলেন, উনি তো ছড়া লিখলেন। আমাকে পাঠালেন ঘাস কাটতে। আর প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। এত প্রশ্ন করে কেউ কাউকে? মাথা ঠিক থাকে!
আজকালকার ছেলেমেয়েকে করে দেখুক না এমন প্রশ্ন! ঘাস কী হবে? বললাম, বেচব কাল। বেচে কী করব তা জানার জন্য হা করে রইলেন। বললাম, বেচে চিকন সুতোর জাল কিনব।
একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। হয়তো আর কোনো প্রশ্ন করবে না সেটা ভেবে। নাহ, কপালে সবার সুখ সয় না। প্রশ্ন যেন ঠোঁটের আগায় রেডি ছিল। ঝপ্পাৎ করে ঝেড়ে দিলেন। ‘জাল কী হবে’? ভদ্র ছেলের মতো বলে দিলাম, নদীর বাঁকে গিয়ে মাছ ধরব ঝাঁকে ঝাঁকে। বলে হাঁটা ধরলাম বাড়ির দিকে।
ও মা! পেছন থেকে আবার প্রশ্ন– মাছ কী হবে? কী মুসিবত! এবারও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলে দিলাম, বেচব হাটে। এবার আর থামলাম না। কারণ জানি তিনি ছাড়বার পাত্র নন। পরের প্রশ্ন শুনে মাথা খারাপ হওয়ার আগেই বলে দিলাম, ‘কিনব শাড়ি পাটে পাটে। বোনকে দেব পাটের শাড়ি। মাকে দেব রঙিন হাঁড়ি’।
বলেই বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। উনি পেছন থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। পরে একটু মায়া হলো। ইস! আরেকটু দাঁড়িয়ে থাকলে ছড়াটা দীর্ঘ হতে পারত।
কয়েক মাস পর শুনি ওই ছড়া নাকি পাঠ্যবইয়ে ছাপা হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দেশের সব মানুষ জানেন আমি ঘাস কাটতে গেছি। পড়লাম বিপাকে। ঘাস না কেটে দেখছি উপায় নেই। কে দেবে মানুষের রাজ্যর প্রশ্নের উত্তর?
কাস্তে হাতে নিয়ে মাঠে চলে গেলাম। সুবজ তরতাজা এক আঁটি ঘাস কাটলাম। নিয়ে গেলাম বাজারে বিক্রি করার জন্য। বেচে চিকন সুতার জাল কিনব। পাশের দোকানে গিয়ে জাল দেখে এলাম। মুলামুলি করে দামও কমিয়ে রেখে এসেছি। ওমা! কেউ ঘাস কিনতে রাজিই হলো না! সবাই নাকি এখন গরুকে খৈল খাওয়ায়। বড় বড় কারখানায় তৈরি ফিড খাওয়ায়, যা খেয়ে গরু বিশুদ্ধ পানির মতো পাতলা ১০ থেকে ১২ সের দুধ দেয়।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। ঘাস বিক্রি আর হলো না। মনের দুঃখে বাড়ির পথ ধরলাম। ঘাসের আঁটি খালে ভাসিয়ে দিলাম।
বাড়িতে ফিরে আমার আক্কেল গুড়ুম। ছোট বোন পাটের শাড়ির অপেক্ষায় বসে আছে। মা রঙিন হাঁড়িতে ভাত রান্না করবে বলে এখনও রান্নাই চাপায়নি। আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। না খেয়েই সে রাতে ঘুমিযে গেলাম।
রাতে স্বপ্ন দেখলাম। বোনকে শাড়ি দিয়েছি। সেই শাড়ি পরে সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা রঙিন হাঁড়িতে খুদের ভাত রান্না করছে।
পর দিন সকালে পাশের বাড়ির এক চাচির কাছ থেকে কিস্তিতে টাকা নিয়ে কিনলাম চিকন সুতোর জাল। জাল নিয়ে চলে গেলাম বিঘাই নদীর বাঁকে। মাছ ধরতে ধরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দৌড়ে গেলাম হাটে।
বিক্রি করে যে টাকা পেলাম তাতে শুধু ধারের টাকাই শোধ হবে। শাড়ি বা হাঁড়ি কোনোটাই হবে না। কী আর করা বাড়ি ফিরে ধারের টাকা শোধ করে মায়ের কাছে গিয়ে কেঁদে ফেললাম। মা পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিলেন। সবচেয়ে দুঃখের কথা হলো– এই ছড়াই আবার আমার দ্বিতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় লিখতে হয়েছিল। পুরোটাই। এ পর্যন্ত বলেই মনা থেমে গেলেন। কিছুটা শান্ত মনে হলো তাকে। পাহাড় নেমে গেছে মনে হলো।
পাশে মোবাইলে গেমস খেলতে ব্যস্ত খোকাকে মনা নিজেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার একমাত্র ছেলে। নাম জিজ্ঞেস করলাম না। জুনিয়র মনা হিসেবেই ধরে নিলাম। হঠাৎ আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। আমি জুনিয়র মনার কানের কাছে গিয়ে বললাম–
মনারে মনা কোথায় যাস?
চট করে মোবাইল থেকে চোখ তুলে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘নিজের ক্ষেতে কাটুন ঘাস
নইলে নদে ধরুন মাছ।’
আমি ভ্যা ভ্যা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমি ঘাস কাটব! ঘাস দিয়ে কী করব? মনে মনে আওড়ে গেলাম, ঘাস। ঘাস। ঘাস দিয়ে কী করব? মুখ ফসকে জোরোশোরেই বের হয়ে গেল,
ঘাস কী হবে?
মোবাইল থেকে মাথা তুলে জুনিয়র মনা বলল,
ফেসবুক পেজে
বেচতে পারেন সকল এজে।
মনাকে দেখলাম মুখ টিপে হাসছে। আর আমি স্তম্ভিত। পুরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ঘাস বেচব ফেসবুকে! কে কিনবে? আমি ফোন বের করে আনমনে ইতস্তত স্ক্রল করা শুরু করলাম। এই অপমানের জ্বালা নেভাতে হবে তো। স্ক্রল করতে করতে একটি এড চোখে পড়ে গেল।
‘ঘাস বেচে আয় করুন ঘরে বসে’। বর্ণনায় ঢুকে দেখি ঘটনা সত্য। ‘মনা’ ডেইরি ফার্মের বিজ্ঞাপন। তারা সবুজ ঘাস কিনে গরুকে খাওয়ান। অর্গানিক দুধ ও মাংস উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। আর্টিক্যালের মাঝখানে আরেকটি আর্টিক্যালের লিংক দেয়া।
যার শিরোনাম, ‘কীভাবে ভালো কাস্তে চিনবেন’? সেখানে ঢুকে দেখলাম কাস্তে বিক্রির বিজ্ঞাপন। হরেকরকম কাস্তের ছবি।
আমি ভালো মানের দুটো কাস্তের অর্ডার দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ করতে হবে। সকালে না গেলে ক্ষেতের ঘাস উধাও হয়ে যেতে পারে।
জুনিয়র মনাকে আর ঘাটালাম না। কারণ এইটথ জেনারেশনের প্রসেসর ওয়ালা ব্রেন। টু জিবি গ্র্যাফিকস কার্ড। এইট জিবি র্যা ম। আনলিমিটেড এইচডিডি। আমি হয়তো জিজ্ঞেস করব, ‘বেচলে কী?’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বলে দিতে পারে, বাজার থেকে কিনবে ঘি। লজ্জায় কি আর পরের প্রশ্নে যেতে পারব। তখন কিনা আমাকে দিয়ে ঘি বিক্রি করায়। না বাপু আমার ঘরে ছোট বোনও নাই। মাও নাই। শাড়ি বা হাঁড়ি কোনোটা কেনারই প্যাড়া নেই।
আপাতত ঘাস কাটার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি। অনলাইনে জমিয়ে দিতে পারলে করোনাকালের সংকট মোকাবেলা করা যাবে।
লেখক: মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ, কবি ও ব্যাংকার
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |