টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি-শহীদ আব্দুর রকিব মিয়া বীরবিক্রম, ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন টাংগাইল মহকুমা, বাসাইল থানার বর্তমানে টাংগাইল জেলার সখিপুর উপজেলার অন্তর্গত শোলা প্রতিমা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতা হাজী হাতেম আলী মুন্সি এবং মাতা হালিমন নেছা। তারা উভয়ে খুবই ধর্ম ভীরু ও সৎ লোক ছিলেন। হাজী হাতেম আলী মুন্সি ও হালিমন নেছার পাঁচ পুত্র ও দুই কণ্যার মধ্যে শহীদ আব্দুর রকিব মিয়া বীরবিক্রম ছিলেন ষষ্ঠ।তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে তৎ কালীন পাকিস্থান নৌবাহিনী তে যোগদান করেন এবং করাচীতে চাকুরীরত ছিলেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্থান ফ্রান্স হতে সাবমেরিন ম্যানগ্রো খরিদ করেন। ফ্রান্সের তুলঁন পোতাশ্রয়ে পাকিস্থান নৌ বাহিনীর খরিদকৃত সাবমেরিন পাকিস্তানে নিয়ে আসতে এবং সাবমেরিনার হিসাবে প্রশিক্ষনের জন্য সেখানে পাকিস্থানী ৫৭ জন নাবিক অবস্থান করে, যার মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন শহীদ আব্দুর রকিব মিয়া বীরবিক্রম। তারা সেখানে অবস্থান কালে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে বিদেশী প্রচার মাধ্যমে এই সংবাদ প্রচারিত হয়। সাবমেরিনে প্রশিক্ষনরত বাঙালি নাবিকরা দেশে গন হত্যার কথা জানার পর অত্যন্ত উদবিঘ্ন হয়ে উঠেন। এ পর্যায়ে তারা সাবমেরিন টি বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রতিরোধ যুদ্ধের সংবাদ এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার মুজাহিদ সদস্যদের মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহনের খবর জানতে পেরে সাবমেরিনে প্রশিক্ষনরত ১৩ জন বাঙালি নাবিকের মধ্যে ৯ নয় জন মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহনের উদ্দেশ্যে জাহাজ ত্যাগ করেন। দীর্ঘ যাত্রাপথে নয়জন নাবিকের মধ্য থেকে আব্দুল মান্নান দলত্যাগ করে লন্ডন চলে যান। অবশিষ্ট ৮ জন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্রান্সের বিভিন্ন শহর ঘুরে, স্পেন ও ইতালী সহ কয়েকটি দেশ হয়ে ভারতে এসে পৌঁছান। এই দলটি ছিল বিদেশে অবস্থানরত পাকিস্থান সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে বিদ্রোহ ঘোষনা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী প্রথম এবং বড় একটি সামরিক দল। বিদ্রোহী দলের কনিষ্ঠ সদস্য স্বল্পভাষী আব্দুর রকিব মিয়া রেডিওতে বিভিন্ন ষ্টেশন ধরে বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবর গুলো টেপ রেকর্ডারে ধারন করে প্রতিদিন তা সকলকে শোনাতে থাকে। আর সে খবর শুনে শুনে তাদের মধ্যে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায় এবং তারা বিদ্রোহ করে সাবমেরিন ত্যাগ করে। তাঁদের সহযোগিতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধ বিশারদগন পাকিস্থানের শক্তিশালী নৌবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আত্মঘাতী নৌ- কমান্ডো বাহিনী সৃষ্টি করেন। পাকিস্থান নৌবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী আটজন দুঃসাহসী সাবমেরিনারের মধ্যে শহীদ আব্দুর রকিব মিয়া বীরবিক্রম একজন।
শহীদ আব্দুর রকিব মিয়া বীরবিক্রম নৌ বাহিনীতে ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক ( ই,এম) , প্রথম শ্রেনী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের পরের বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেননি। যুদ্ধ চলাকালে একটি দুধর্ষ অপারেশন চালাতে গিয়ে তিনি শহীদ হোন। তার বীরত্বের জন্য খেতাব দেওয়া হয় বীরবিক্রম।
মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও রাজনৈতিক কারনে বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ বিবেচনায় কয়েকটি বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ও সর্বাধিক কার্যকর বাহিনী হচ্ছে নৌকমান্ডো বাহিনী। এদের প্রশিক্ষন হয় ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার ভগীরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরে। বাংলার স্বাধীনতা হারানোর নীরব সাক্ষী এই পলাশী। অতীতের হারিয়ে যাওয়া পরাজয়ের গ্লানি সেখানে নিয়ত খাঁ খাঁ করে গভীর শূন্যতায়। এখানেই ভগীরথী নদীর একপাড় ধরে ঘন বাবলা বনের ছায়ায় স্থায়ী ভাবে স্থাপন করা হয় নৌকমান্ডো ক্যাম্প। ১৫ মে দিল্লীর নিকটবর্তী যমুনা নদীতে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের নৌ প্রশিক্ষন শেষ করে, ফ্রান্সের তুলঁন থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি নৌসেনারা। তাদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং কর্ণেল ওসমানী ও ভারতীয় নৌবাহীনির একান্ত সহায়তায় ২৭ মে পূর্ণাঙ্গ পরিসরে নৌ প্রশিক্ষন ক্যাম্প সচল করা হয় পলাশীতে। সর্বাত্মক গোপনীয়তায় স্থাপিত এই প্রশিক্ষন ক্যাম্পর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ‘সি -২ পি’। পরবর্তীকালে এই সি-২ পি ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত নৌকমান্ডোরা গোটা বাংলাদেশের জলসীমায় যে ধ্বংসাত্মক ও মরণঘাতী অভিযান চালায় ভবিষ্যতের বিরাট সাফল্যের কথা বিবেচনা করে তার সাংকেতিক নাম রাখা হয় ‘অপারেশন জ্যাকপট’ অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি হতে ডিসেম্বরের চুড়ান্ত সামরিক বিজয় অর্জন পর্যন্ত প্রায় চার মাস সময়ে বাংলাদেশের সমুদ্র ও নদনদী সমূহের জলভাগে একের পর এক অগনিত অভিযান চালানো হয়। এক হাজার সদস্যের একটি চৌকস ও দুঃসাহসী নৌকমান্ডো বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকলেও ফ্রান্স ফেরৎ আটজন সাবমেরিনার সহ মোট নৌ কমান্ডোর সংখ্যা ৪৯০ জন। ফ্রান্সের তুলঁন হতে আসা আটজন সাবমেরিনার পলাশীতে প্রশিক্ষনের দায়িত্ব পালনের পর বাংলাদশের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব দেওয়াসহ বিভিন্ন নৌ অভিযানেও সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়। এদের মধ্যে আব্দুর রকিব মিয়া উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন নৌ এলাকায় অপারেশন চালান। এই সব অপারেশনের এক পর্যায়ে তিনি যমুনা নদীতে ফুলছড়ি ঘাটের অদূরে চলন্ত জাহাজে মাইন লাগানোর সময় পানির প্রচন্ড স্রোতের তোড়ে তলিয়ে যান এবং তার শরীর জাহাজের ঘূর্ণায়মান প্রপেলারের সাথে লেগে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক পরে দূরের এক চরায় এই অসম সাহসী বীরের ক্ষত বিক্ষত নিথর শরীর ভেসে উঠে। স্বাধীনতার এতো বছর পরে আজকের ফুলছড়ি এলাকায় একাত্তুরের শহীদ আব্দুর রকিবের নাম কেউ মনে রেখেছে কিনা জানিনা। তবে এটা নিশ্চিত যে, মুক্তি পাগল এই বীরের অবিনশ্বর বীরত্বের কাহিনী অতৃপ্ত হাহাকার নিয়ে আরো বহুদিন ভেসে বেড়াবে বাংলাদেশের আলো বাতাস।
আজ সেই ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে যিনি এই দিনে শাহাদৎবরন করেন।
আব্দুর রকিব মিয়া কে নৌ বাহিনীতে এ আর মিয়া নামে অভিহিত করা হতো। দেশ প্রেমিক আট জন সাবমেরিনের মধ্যে আমার সৌভাগ্য হয়েছে দু জন বীর শ্রদ্ধেয় জনাব আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীরউত্তম ও বীরবিক্রম এবং শ্রদ্ধেয় জনাব আবিদুর রহমান বীরবিক্রম চাচাদের সাথে সরাসরি কথা বলবার। তাদের মুখে শুনেছি “তোমার চাচা আব্দুর রকিব মিয়া ছিল অসমসাহসী এবং নিখাত দেশপ্রেমিক। সে সহ আমাদের আটজনের লক্ষ্যই ছিলো যেকোন ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করা এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা।” আমার সুযোগ হয়েছে নৌকমান্ডো শ্রদ্ধেয় মোঃ খলিলুর রহমান চাচার সাথে কথা বলবার তিনিও বলেছেন ” তোমার চাচার সাহসের তুলনা ছিলনা তাকে সর্বোচ্চ খেতাব দিলেও কম হতো।” আরো অনেকের অনেক কথা শুনেছি। আমার বাবাকেও দেখেছি তার শ্রদ্ধেয় ভাইয়ের ছবিটি কে অনেক যত্ন করে রাখতে এবং তার কথা স্মরন করে নির্বাক হয়ে যেতে। আমার বাবার কাছে আমি অনেক ইতিহাস জেনেছি তার চোখ ছলছল করতে দেখেছি আমার শ্রদ্ধেয় চাচা শহীদ আব্দুর রকিব মিয়া বীরবিক্রম এবং ১৯৬৯ এর গনঅভ্যূত্থানে শহীদ আসাদ এর কথা বলতে গিয়ে। শহীদ আসাদ যে মিছিলে শহীদ হোন সেই মিছিলে আমার বাবাও ছিলেন। আমার বাবা জীবিত আছেন তিনি অসুস্থ তার জন্য দোয়া চাই। শ্রদ্ধেয় চাচা শহীদ আব্দুর রকিব মিয়া বীরবিক্রম এর আত্মার মাগফেরাত কামনা সহ মহান রাব্বুলআলামিন এর নিকট প্রর্থনা করি যেন আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন।