বাবুল তালুকদার: ‘‘ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পাওয়া জনগনের অধিকার। এই অধিকার থেকে জনগন বঞ্চিত না হয় সেজন্য বিএনপি প্রথম থেকে এই ভ্যাকসিন বিনামূল্যে সরবারহের দাবি জানিয়ে আসছে। জনগন যাতে এই ভ্যাকসিন সঠিকভাবে পায় সেটা অবশ্যই সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।”
বুধবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, ভ্যাকসিন ক্রয়ে সরাসরি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি না করে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে (বেক্সিমকো) চুক্তি করায় বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অভিযোগ করে সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, ‘‘ এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনের প্রতিটি ডোজের দাম প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। অন্যদিকে যদি সরাসরি সরকার ভ্যাকসিন ক্রয় করতো তাহলে প্রায় অর্ধেক দামে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পেতো। এতে শত শত কোটি টাকা দেশের সাশ্রয় হতো।” ‘‘ শুধুমাত্র একটি গোষ্ঠিকে আর্থিকভাবে লাভবান করতেই এই ধরনের চুক্তি করা হয়ে্ছে।”
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন-উর রশীদ, মহাসচিব অধ্যাপক আব্দুস সালাম প্রমূখ।
ড. মোশাররফ বলেন,‘‘ বিনা ভোটের সরকার ক্ষমতায় থাকায় জনগনের প্রতি তাদের ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। তাদের অদূরদর্শিদতা ও লুটপাটনীতির কারণেই ভ্যাকসিন নিয়ে আজ অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। যে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে তার থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে অনতিবিলম্বে ভ্যাকসিন সংগ্রহ, মূল্য, সংরক্ষন এবং বিতরণ ব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য জনগনের সামনে উপস্থাপনের জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।” ‘‘ সেই সাথে ভ্যাকসিন সরবারহের জন্য অতিদ্রুত বিকল্প উতস্য খুঁজে বের করার জন্য আহবানও জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, ‘‘ ভ্যাকসিন নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়ে সরকার একটি স্বর্থান্বেষী মহলকে শত শত কোটি হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, যে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও ভ্যাকসিন আবিস্কারক এই ভ্যাকসিন থেকে কোনো ধরনের রয়েলিটি বা লভ্যাংশ নিচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশ এটি নিয়ে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।”
বিকল্প উতস্যে ভ্যাকসিন কোন দেশ থেকে আনার কথা বলছেন প্রশ্ন করা হলে ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘‘ ফাইজার ও মর্ডানের ভ্যাকসিন সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল যে, এটা সংরক্ষনে একটা ৭০ ডিগ্রি মাইনাস এবং আরেকটা ২০ ডিগ্রি মাইনাস তাপমাত্রা লাগে। এসব আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য না এবং আমাদের দেশে এসব আনাও সম্ভব হবে না।”
‘‘ এছাড়া অন্যান্য দেশ যেমন রাশিয়া স্পুটনিক টাস্ক, চীন সিনো ফার্মা অনুমোদন দিয়ে তারা ইতিমধ্যে টিকা দিচ্ছে। অতত্রব ৩ বা ৪টি টিকাই এভেলেবল হবে তা নয়। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েকটি ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়েছে তবে তাদের কাছে ৫০টি টিকার ব্যাপারে এমপ্লাই করা আছে। তারা ওইসব বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা শেষ হলে অনুমোদন দিচ্ছে। তাই বিকল্প বলতে আমরা যেসব টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত আমাদের দেশের তাপমাত্রায় সংরক্ষনযোগ্য টিকা এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে দেয়া হচ্ছে সেগুলোর সাথে নেগোসিয়েশন করা হলে আরো কম দামে আমাদের দেশ টিকা পেতে পারতো। এখনো সুযোগ আছে বলে আমরা সরকারকে বিকল্প উতস্য খোঁজার জন্য আহবান জানাচ্ছি।”
ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটের অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের ও বেক্সিমকো প্রধান নির্বাহীর বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ বাংলাদেশ সরকারের সাথে জি টু জি চুক্তি হয়েছে বলে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জানিয়েছে।আবার বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সরকারের সঙ্গে নয়, চুক্তি হয়েছে বেক্সিমকোর সাখে বা বানিজ্যেক চুক্তি। গতকাল তড়িগড়ি করে করোনা ভাইরাস টিকা কেনার জন্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেখানেও রাখা হয়েছে বিশাল দুর্নীতির খাত।”
‘‘ ভ্যাকসিন ক্রয় করতে গিয়ে সরাসরি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না করে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে (বেক্সিমকো) চুক্তি করায় আর্থিক ভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনের প্রতিটি ডোজের দাম প্রায় দ্বিগুন পড়বে। যদি কয়েক কোটি ভ্যাকসিন আমদানিও হয় তা সাধারণ মানুষ আদৌ সে ভ্যাকসিন পাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”
করোনা ভ্যাকসিন বিতরণের জন্যও সরকারের প্রস্তাবিত জেলা, উপজেলা কমিটির মাধ্যমে টিকা সরবারহ করা হলে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের কাছে এই ভ্যাকসিন যথাযথভাবে পৌঁছাবে না বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী।
ভ্যাকসিন বিতরণের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রণীত গাইড লাইনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘ ওই গাইড লাইন অনুযায়ী যাদের ভ্যাকসিন পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে তাদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার মাধ্যমে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিবর্তে অন্যদেরকে এই ভ্যাকসিন দেয়ার প্রস্তাবনা রয়েছে সরকারের প্রণীত নীতিমালায়। দেশের ৬০ বছরের অধিক বয়সী জনগোষ্ঠি, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠি, প্রাধিকার প্রাপ্ত জনগোষ্ঠি, সম্মুখ সারির করোনা যোদ্ধারা বঞ্চিত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে যা কোনভাবে গ্রহনযোগ্য নয়।”
‘‘ বেসরকারি খাতে উচ্চ মূল্যে চিহ্নিত কতিপয় মহলের নিকট প্রায় তিন মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রি সরাসরি জনগনের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি।স্বাস্থ্য সুরক্ষা জনগনের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে সাধারণ মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ কোনভাবে গ্রহনযোগ্য নয়।”
‘‘ স্বার্থাস্বেষী মহলকে খুশি রাখার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদিও অনেক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও দেশ অনেক আগেই ভ্যাকসিন ট্রায়াল ও পরবর্তিতে স্বল্পমূল্যে দেয়ার প্রস্তাব দি্য়েছিলো।কিন্তু সেটি গ্রহন করা হয়নি। যদি একাধিক প্রস্তাব গ্রহন করা হতো তাহলে ভ্যাকসিন নিয়ে আজ এই অনিশ্চিয়তা হতো না।”
করোনাভাইরাস সংক্রামণের প্রথম থেকে স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘ করোনা পরীক্ষা, শনাক্তকরণ, মৃতের সংখ্যা এসব বিষয়ে জনমনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন রয়েছে, সঠিক তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি রঢেছে। যথাযথ শনাক্তকরণ ও পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারের এক ধরনের উদাসিনতা প্রথম থেকে লক্ষ্যনীয়। সেই ধারাবাহিকতায় একটি স্বার্থন্বেষী মহলকে বর্তমান সরকার ভ্যাকসিন ক্রয় ও বিতরণে দায়িত্ব নিয়ে জনগনের শত শত কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ করে দিচ্ছে।”
ভ্যাকসিন সম্পর্কে দলের পক্ষ থেকে গত সাপ্তাহে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যাূেয়ের এই কমিটি গঠন করা হয়।