আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | দুপুর ১:০৩
এম আবদুল্লাহ:- আগস্টের ৫ তারিখ। কারফিউ চলছে। কী হচ্ছে, কী হবে এমন এক টান টান উত্তেজনা। শ্বাসরুদ্ধকর আবহ। ব্যস্ত নগরী ঢাকা সকাল ১০ নাগাদ সুনসান। ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ছিল এই দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ ডাক দেন। সমর্থন দেয় বিরোধী রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো। আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে একই দিন গণভবন ঘেরাওয়ের ডাক আসছিল।
আগের মধ্যরাতে ডিএমপির কমিশনার হুংকার দেন। বেশ কঠোর উচ্চারণে নগরবাসীকে কারফিউ মানতে বলেন। রাস্তায় নামতে বারণ করেন। উদ্বেগ-আতঙ্ক দিকে দিকে। তবে সবার দৃষ্টি ছিল জলপাই রঙে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে দিন কয়েক আগে থেকেই কারফিউ জারি করেছিল হাসিনা সরকার। মাঠে ছিল সেনাবাহিনী। মসনদ রক্ষার শেষ চেষ্টায় দেশরক্ষা বাহিনীকে মুক্তিকামী জনগণের মুখোমুখি করার চেষ্টা করছিলেন শেখ হাসিনা।
মূলত ৫ আগস্ট পূর্বাপর ঘটনা প্রবাহে সবার আগ্রহ ও কৌতূহলের কেন্দ্রে চলে আসে সেনাবাহিনী। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, কোটি চোখ ছিল শেখ হাসিনার আত্মীয় হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের দিকে। সারি সারি লাশ আর রক্তস্রোত থামাতে তিনি কী ভূমিকা নেন, সেদিকে অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল দেশি-বিদেশি সব মহলের।
দেড় দশকের বেশি সময় অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। আগস্টের পঞ্চম দিনটি যে তার ভাগ্য নির্ধারণী দিন হবে, তা সাধারণের পক্ষে আঁচ করাও ছিল কঠিন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও ছিলেন বিভ্রমে। আশা-নিরাশার দোলাচল ছিল জনমনে। কারফিউ জারির পর অনেককে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, ‘হাসিনা বোধহয় আবার টিকে গেল।’
গদি রক্ষায় সহস্রাধিক প্রাণ কেড়ে নিয়েও থামতে চাননি শেখ হাসিনা। তিনি সেনাবাহিনীকে ঢাকামুখী ছাত্র-জনতার দিকে বন্দুক তাক করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। গণভবন নিরাপদ রাখতে গুলির ব্যবহারে অকৃপণ ও নির্দয় হতে বলেছিলেন। তার শেষ অবস্থান ছিল—যত প্রাণ যায় যাক, তবু তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। সেই কঠিন সময়ে দেশরক্ষা বাহিনী উদ্বেগকুল জনগণকে হতাশ করেনি। দেশপ্রেমের সুকঠিন পরীক্ষায় অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
জেনারেল ওয়াকারের নেতৃত্বে সেনাসদর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়—না, তারা জনগণের বুকে গুলি চালাবেন না। রক্তপাত আর বাড়তে দেবেন না। লাশ ও রক্ত আর দেখতে চান না। জনগণের পক্ষেই হবে তাদের অবস্থান। একই সঙ্গে লাল কার্ড দেখিয়ে দেন ক্ষমতার নেশায় বুঁদ মহারানিকে। মূলত এই সময়োপযোগী সাহসী বার্তাই দুর্বিনীত স্বৈরাশাসক শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। মাত্র কয়েক দিন আগে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ মর্মে দম্ভোক্তি করা শেখের বেটিকে পালাতে হয় দ্রততম সময়ে। ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেনাসদরে বসেন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে রক্তস্রোত থামানোর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেন। তার পরের ইতিহাস সবার জানা।
একেবারে নিকট অতীতের ইতিহাসটি সংক্ষেপে পাঠ করে নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব যারাই দাবি করেন না কেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অবদান যেন কেউ ভুলে না যান। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাহসী নেতৃত্বে সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে না দাঁড়ালে ইতিহাস অন্যরকমও হতে পারত। যেমনটি হয়েছিল ২০১৩ ও ’১৫ সালে। সে সময় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে তীব্র আন্দোলন সত্ত্বেও সেনাছাউনি নির্বিকার থাকায় ফল হয় শূন্য। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ট্যাঙ্কের ওপর সিপাহি-জনতার মিলিত উল্লাসই কিন্তু স্বৈরশাসক হাসিনাকে পালানোর চূড়ান্ত বার্তা দেয়। শেখ হাসিনা কিন্তু বেলা ৩টা পর্যন্ত বিমানে বসে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। জনতার গণভবন দখল ও সৈনিক-জনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস-উল্লাস দেখেই ৩টা ২০ মিনিটের দিকে তাকে বহনকারী বিমান দিল্লির পথে উড়াল দিতে বাধ্য হয়।
আর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সেনাবাহিনী অকুণ্ঠ সমর্থনের ফলে প্রতিবিপ্লবের কয়েকটি চেষ্টা যে ভণ্ডুল করা সম্ভব হয়েছে, সেটাও বিস্মৃত হলে চলবে না। এখনো মানুষের আস্থার কেন্দ্রে রয়েছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। যে কারণে, সেনাপ্রধানকে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে আশ্বস্ত করতে হচ্ছে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। গত সপ্তাহ দুয়েক নানা গুঞ্জন ডালপালা মেলছিল। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর তা অনেকটাই কেটে গেছে।
আলোচিত ওই সাক্ষাৎকারে দৃশ্যত নির্বাচনের একটি পথরেখা উপস্থাপন করেছেন সেনাপ্রধান। জোর দেন সংস্কারেও। পরিস্থিতি যাই হোক, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাক্ষাৎকারটি গত কয়েক দিন ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
নির্বাচনের একটি সময়সীমা প্রকাশের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি জোরদার হচ্ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে নির্বাচনের সময়সীমার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। সেনাপ্রধানই প্রথম এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন সেনাপ্রধান। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেন তার মিশন সম্পন্ন করতে পারেন, সে কথাও বলেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
এদিকে সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকারের দুদিনের মাথায় খানিকটা ভিন্ন বক্তব্য এসেছে সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে। সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত ও ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূস। বুধবার নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলেছেন তিনি।
ক্ষমতার অন্যতম প্রধান দাবিদার বিএনপি মনে করে, সরকার আন্তরিক হলে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে আগামী ১৮ মাসের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। আর এটি যত দ্রুত করা সম্ভব হবে, ততই দেশ, জনগণ এবং সরকারের জন্যও মঙ্গল হবে। সরকারের কাছ থেকেও নির্বাচনের সময় নিয়ে রোডম্যাপ আশা করে দলটি।
অবশ্য জামায়াতের প্রতিক্রিয়া একটু ভিন্ন। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গত বুধবার বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে এক্ষুনি সময়-দিন-ঘণ্টা বেঁধে দেওয়ার সময় আসেনি। আমরা যেটা বরাবরই বলে আসছি, একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কতগুলো সংস্কার দরকার। সেটা হওয়ার পর সবাই বুঝবে যে নির্বাচনের পরিবেশ হয়েছে। সেজন্য আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেছি। এটা যৌক্তিক সময়, খুব লম্বা হবে না, আবার সংক্ষিপ্তও হবে না।’
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের জেরে প্রতিক্রিয়া এসেছে আওয়ামী লীগের তরফেও। দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যে সন্তোষ জানিয়েছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তবে তিনি এও বলেছেন, এ সময়সীমা তার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ছাড়া সত্যিকারের সংস্কার ও নির্বাচন অসম্ভব বলেও মন্তব্য করেন জয়। ওয়াশিংটনে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জয় বলেন, ‘অন্তত এখন যে আমরা (নির্বাচনের) একটা সময়সূচি পেলাম, এতে আমি খুশি।’
রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে রাখা প্রসঙ্গেও সেনাপ্রধান মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, এটা শুধু তখনই ঘটতে পারে, যখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য থাকে, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে। সেনাপ্রধানের এ বক্তব্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। জনসাধারণ দেশরক্ষা বাহিনীকে দেশের ক্রান্তিকালে যেমন ত্রাতার ভূমিকায় দেখতে চায়, তেমনি এ বাহিনীর ক্ষমতার অপচর্চা ও উচ্চাভিলাষ দেখতে চায় না। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। এ মন্ত্রণালয় সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির অধীনে নেওয়ার যে প্রস্তাব করেছেন, তা সংবিধান সংস্কারে গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান আরও বলেছেন, সেনাবাহিনী অশান্ত পরিস্থিতির পর দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, একসঙ্গে কাজ করলে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’ কাঙ্ক্ষিত পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার সেনাবাহিনীকে পেশাদার রাখতে চাই।’ বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিক অতীতে সেনাপ্রধানসহ বাহিনীর অনেকের অপেশাদার আচরণ, অর্থ ও ক্ষমতার প্রতি লোভ বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনকে প্রলম্বিত করেছে। দেশরক্ষা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান পেশাদারিত্বের যে বার্তা দিয়েছেন তাতে এটাই স্পষ্ট যে, তিনি দেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে চান। এটা তার নিজের ভাবমূর্তি যেমন সমুজ্জ্বল করেছে, তেমনি বাহিনীর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। এজন্য তিনি সাধুবাদ পেতে পারেন।
(লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে)
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |