আজ সোমবার | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১২:৪৭
অধ্যাপক,শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন :-“অনেক স্বেচ্ছাসেবী মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশ সৎকার করেছেন; অনেকে বিলিয়েছেন ত্রাণ ও খাবার। করোনাকালে আমরা হারিয়েছি আমাদের জ্ঞানরাজ্য ও সাংস্কৃতিক জগতের কয়েকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। মহামারির সময়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন আমাদের অগণন ‘সিনিয়র সিটিজেন’ বা জ্যেষ্ঠ নাগরিক, যে ক্ষতি অপূরণীয় ”
একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। বয়স প্রায় আশির কোঠায়। তিনি আমার খুব প্রিয়ভাজন এবং শ্রদ্ধাস্পদ। করোনা মহামারি নিয়ে কথা বলতে বলতে তার ছেলেবেলাকার স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। তার ঠোঁট তির তির করে কাঁপছিল, চোখের কালো মণিটি ছিল স্থির। তিনি আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন। তখন বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ছিল কলেরার উপদ্রব। তখনকার মানুষ যেটিকে কলেরা বলত, আমরা সেটিকে বলি ডায়রিয়া। পেটের পীড়া। হাতের কাছে ওষুধ পাওয়া যায় বলে আমরা এর ভয়াবহতা বুঝতে পারি না। পেটের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে একজন অনবরত শৌচাগারে যাওয়া-আসা করছেন, কিছুই খেতে পারছেন না বা খেলেও পেটে রাখতে পারছেন না। দু-এক দিনের মধ্যেই শরীর নিস্তেজ হয়ে তাকে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
১৮১৭ সালে প্রথম কলেরা মহামারি দেখা দেয় পদ্মা (বা গঙ্গা) নদীর উর্বর বদ্বীপ সমভূমিতে। এর উৎপত্তিস্থল ছিল যশোর ও ঢাকা। তারপর এটি ছড়িয়ে পড়ে ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায়। ১৮২০ সালের মধ্যে কলেরা মহামারি বিস্তৃত হয় থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ইরাক এবং তুরস্ক হয়ে ইউরোপের প্রান্তসীমায়। এরপর এটি আরবের বাণিজ্যপথ ধরে ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে। গত দুই শ বছরে সাত দফায় কলেরা মহামারিতে মৃত্যু হয়েছে ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখনো বিশ্বে প্রতিবছর ৪০ লাখ লোক কলেরায় আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন ২১ হাজার থেকে দেড় লাখ মানুষ।
ওই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তার কিশোর বয়সে দেখা স্মৃতির অবতারণা করে মৃত্যুর কথা বলছিলেন, নিস্তব্ধ শবদেহের সারি ও সেসবের সৎকারের কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, কলেরায় তখন এক হাজার লোকের ভেতরে একজন বাঁচত। গ্রামে কলেরা মহামারি দেখা দিলে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে যেত। শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু! এত মৃত্যু যে, গোসল এবং জানাজা ছাড়াই লাশগুলো নামিয়ে দেয়া হতো গণকবরে। করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশে আমাদের এমন দৃশ্য দেখতে হয়নি। তবে ইউরোপ ও আমেরিকার অবস্থা ছিল ভয়াবহ!
গত ১০ মাস ধরে ইতালি, আমেরিকা, স্পেন, ব্রাজিল ও ব্রিটেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। ইতালি ও স্পেনে প্রথম দিকে বিশাল আকৃতির শকট ভরে লাশ ভরাট করে শবদেহগুলো নামিয়ে দেয়া হতো গণকবর। মহামারিক্লিষ্ট চীন, আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষের অন্তরাবর্তন দেখে আমরা শঙ্কিত হয়েছিলাম। ডাক্তার ও নার্সরা পিপিই পরে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করছেন, মনে হচ্ছিল একদল অ্যাস্ট্রোনট মৃত্যুপথযাত্রী একজন ব্যক্তিকে ঘিরে আছেন, মৃত্যু হলেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে দূর আকাশের ছায়াপথে। পরিবার-পরিজনের কেউই তার কাছে যেতে পারছেন না; মৃত্যুর সময়ে কোনো কোমল হাতের একটু ছোঁয়া স্পর্শ করতে পারছে না তার চিবুক; প্রিয়তম পুত্র বা কন্যাদের কেউ বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলতে পারছে না, ‘আই লাভ ইউ মাম্মি (অথবা পাপা)।’. আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে ভেবেছিলাম, ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা বাংলাদেশের হলে পথে পথে লাশ পড়ে থাকবে। প্রথম দিকে ৫-৭টি হাসপাতাল ঘুরে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। হাসপাতাল নেই, আইসিইউ নেই, ভেন্টিলেটর নেই- সে কী অবস্থা! মহামারির বিস্তারে তৈরি হলো উৎকণ্ঠা, চিত্তোদ্বেগ ও বিকার। আবার শঙ্কা ও নৈরাশ্যের মধ্যে অনেকের মধ্যে জন্ম নিল অতি-আশাবাদ। অনেকে ভাবলেন, মহামারিতে জীবনের অনিত্যতা দেখে লুটেরা, দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজেরা আত্মসংশোধনে প্রবৃত্ত হবেন। লুটপাট, দুর্নীতি, অপরাধ, সন্ত্রাস- এসব বন্ধ হবে। একেবারে বন্ধ না হলেও অনেকটা কমবে বলে অনেকে সুনিশ্চিত প্রত্যয়ে থিতু হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইনকরিজিবল’, ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের আবিষ্কার করে আশাবাদীরা হতোদ্যম হতে লাগলেন। দেখা গেল যে, শুধু উজির-নাজিরই নয়, স্বাস্থ্য বিভাগের ড্রাইভার-খানসামারাও শতকোটি টাকার মালিক!
ঘরে ঘরে স্বামীরা স্ত্রীদের অধিক হারে নির্যাতন করা শুরু করলেন, বাচ্চারাও প্রহৃত হতে লাগল। করোনার প্রথম দিকে ইতালিফেরত স্বামীকে দেখে স্ত্রী পালিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে; আপন ছেলেমেয়ে, ও জামাই মিলে জ্বরাক্রান্ত মাকে করোনা সন্দেহে ফেলে দিয়ে এলেন গাজীপুরের শালবনে; করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে এক ঘরে করে দিতে লাগলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা; ডাক্তার ও সাংবাদিকদের বাড়িছাড়া করতে উঠেপড়ে লেগে গেলেন বাড়িওয়ালারা। এই কয়েক মাস আগের কথা। কিন্তু কী ভয়াবহ ও মর্মান্তিক! মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত মানুষের বিকারগ্রস্ত আচরণ।
লকডাউনের দিনগুলোতে দোকানপাট, অফিস-আদালত, কলকারখানা- সব বন্ধ। দিনে-দুপুরে রাস্তাঘাটগুলো ফাঁকা, শুধু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু মানুষ ও রিকশা। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত নগরীর মহাব্যস্ত সড়কগুলোতে কবরের নিস্তব্ধতা! মানুষের চোখেমুখে মৃত্যুর ভয়। চারদিকে কিলবিল করছে করোনাভাইরাস। মুখগহ্বরের মধ্য দিয়ে একবার শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারলে শুরু হয়ে যাবে ‘মাল্টি ওরগান ফেইলিউর’। পরিশেষে আক্রান্ত হবে ফুসফুস; যমদূত এসে পরপারের সনদ ধরিয়ে দেবে হাতে। মৃত্যুভয়ে মানুষের সে কি আতঙ্ক! মুখগুলো পান্ডুর; চোখে নির্বিকার নির্মোহ; মনে হয়েছিল প্রদোষকালীন বিষণ্নতা গ্রাস করেছে সমগ্র পৃথিবীকে।
সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করল। বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ছিল আশাতীতভাবে কম। বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেও ঘরে বসেই সুস্থ হতে শুরু করলেন। মানুষের ভয় কাটতে শুরু করল। স্রোতের মতো মানুষ বেরিয়ে আসতে শুরু করল রাস্তায়, দোকানে ও ময়দানে। নগরীর পথে পথে আগের দুর্গন্ধ, যানজট, হল্লা ও নাগরিক নৈরাজ্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময়মতো লকডাউন তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করে এবং জীবিকাসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে সাহসী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ করেছিলেন। নইলে হতদরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, ও প্রান্তিক মানুষেরা না খেতে পেয়ে মারা যেত। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা বেহালতর হলো। উচ্চমাধ্যমিকের অটোপাস মানহীন শিক্ষার কফিনে প্রমাণ সাইজের একটি পেরেক ঠুকে দিল। লুটেরা ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করার জন্য বিনা মূল্যে ডেটা দেয়া হলো না।
লকডাউনের সময়ে সবকিছু বন্ধ থাকায় কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে প্রতিদিন আনুমানিক গড় ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ব্র্যাকের করা একটি জরিপ অনুযায়ী করোনাকালে নিম্নবিত্তের আয় কমেছে ৭৫ ভাগ এবং চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতির এমন দুরবস্থা এবং দরিদ্র মানুষের চরম দুর্বিপাকেও থেমে থাকেনি লুটপাট, প্রতারণা, দুর্নীতি ও বড়লোক হওয়ার ঊর্ধ্বগতি। করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে শাহেদ-সাবরিনাদের প্রতারণায় সারা বিশ্ব শিউরে উঠেছে। পিপিই ও মাস্ক নিয়ে উজির-নাজিরদের দুর্নীতিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে অনেক চিকিৎসক ও পুলিশ কর্মকর্তাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন- এই তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন।
করোনাকালে ডাক্তাররা অসীম সাহসিকতা নিয়ে ‘ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা’ হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘মানবিক পুলিশের’ অনন্য উদ্যোগ নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশ সৎকার করেছেন; অনেকে বিলিয়েছেন ত্রাণ ও খাবার। করোনাকালে আমরা হারিয়েছি আমাদের জ্ঞানরাজ্য ও সাংস্কৃতিক জগতের কয়েকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। মহামারির সময়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন আমাদের অগণন ‘সিনিয়র সিটিজেন’ বা জ্যেষ্ঠ নাগরিক, যে ক্ষতি অপূরণীয়।
করোনাকালের মৃত্যু ও মৃত্যুভয় আমাদের অনেককেই, আমরা যারা এখনো সত্য, শুভ ও শ্রেয়বোধে আস্থা রাখি, তাদের দিয়েছে এক অতীবর্তী অন্তর্দৃষ্টি, কবি জীবনানন্দ দাশের মতো। অন্তর্গত বোধের এই কবি তার ‘মানুষের মৃত্যু হ’লে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়;/ অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে/ প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।/ আজকের আগে যেই জীবনের ভীড় জমেছিল/ তা’রা ম’রে গেছে;/ প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে/ অন্ধকারে হারায়েছে;/ তবু তা’রা আজকের আলোর ভিতরে/ সঞ্চারিত হ’য়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে…’ লেখক: অধ্যাপক,শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |.
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |