আজ সোমবার | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১২:২২
তাহমিনা ইয়াসমিন শশী :- আজকাল আর আফিসে যেতে ভাল লাগেনা। মনটা সারাক্ষণ মৌন হয়ে থাকে কিসের যেন এক অজানা ভয় মনকে ভীত করে রাখে। এখন আর অফিসে বসে গল্প হয়না কলিগদের সাথে এমনকি একসাথে কফি খাওয়া যায়না। এক রুমে ২ জনের বেশী অবস্থান করা যায়না।
পুলিশ স্টেশনে ইমিগ্রেশন অফিসে অভিবাসীদের ভীর আর দেখা যায়না। প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও আজকাল আর সরব নয়।
পাবলিক চলাচলের মাধ্যম বাসে, ট্রেনে, ট্রামে এখন আর দেখা যায়না যাত্রীদের সমাগম। গত বছর চীনের উহান থেকে অজানা নতুন করনা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। কোন প্রতিষেধক ও নিরাময়ক না থাকায় এর সংক্রমন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেয়া হয় সামজিক বা সারিরিক দূরত্ব বজায় রাখার উপর।
ভ্যাটিকানে মানুষ বিহীন কবুতর। ভেনিসের গন্দলায় জলে ভাসছেনা নব দম্পত্তি আর পর্যটক। সমগ্র ইতালি আজ যুদ্ধ ছাড়াই অবরুদ্ধ।
অস্থিরতায় ভুগছি কিছুতেই মন ভালো লাগছিলনা। অকারণে মোবাইল নাড়াচাড়া করছি তখন চোখে ভেসে এল একটা ইমেইল বক্স।
যথারীতি ইমেইল পড়ে মনের অজান্তেই আনন্দে লাফ দিয়ে উঠলাম। আমাকে ইমেল করে জানানো হয়েছিল আমার লিখা গল্পটি তৃতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে। আনন্দে কান্না চলে আসল। কিন্তু করনা ভাইরাস এর জন্য অনুষ্ঠানটি অনলাইনে করা হবে।করনার প্রকোপে সমগ্র ইটালি যেন আজ স্তম্ভিত তাই পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি ভার্চুয়াল ভাবেই সম্পন্ন হবে।
৩২ বছর যাবত ইটালির তরিনো শহরে চলে আসছে আন্তজাতিক বই মেলা। প্রায় সব দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বই মেলাটি উদযাপিত হয়ে আসছে।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে আমাদের পার্শ্ববর্তি দেশ ভারত, পাকিস্তান, চীন এর মত দেশের উপস্থিতি দেখা গেলেও দেখা মেলেনি বই মেলায় বাংলাদেশের কোন বই এর স্টল।
যে দেশে ২১ শের বইমেলা হয়, যে দেশের মানুশ ভাষার জন্য প্রান বিলিয়ে দিয়েছে নির্দ্বিধায়। সে দেশ কেন পিছিয়ে যাবে বিশ্বদরবারে ? যে দেশে কেবি নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি জসীম উদ্দিন, বেগম রোকেয়া, খান মোহাম্মমদ ফারাবি, ফকির গরিবুল্ললাহ, হমায়ুন আহমেদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, জিবনানন্দ দাশ, মীর মোশারফ হোসেন আরও অনেক গুনি লেখক কবি সাহিত্যিকদের জন্ম। সে দেশ কেন পিছিয়ে যাবে?
আমরা কি শুধু বহিঃবিশ্বে শ্রমজীবী হিসেবেই থেকে যাবো?
INTERNATIONAL BOOK FAIR FESTIVAL TORINO ONLINE AWARD এর দিন আমার সাথে পরিচয় হয় ইতালির একজন লেখিকার সাথে যার নাম SILVIA FAVARETTO .সিল্ভিয়া তার লিখা গল্পের জন্য পেয়েছিল স্পেশাল পুরস্কার আন্তজাতিক বই মেলা থেকে। ইতলিয়ান এই লেখিকাকে নিয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয় কারন তিনি বাংলা ভাষায় কবিতা লিখেছিলেন তাই । আমি সত্যি খুব বেশী আবেগে আপ্লূত হই তার বাংলা ভাসার উপর ভালবাসা দেখে। তিনি কখনো বাংলাদেশে যাননি কিংবা তিনি বাংলাদেশিও নন।
সিল্ভিয়া একজন শিক্ষিকা এবং গবেষক _” IBERIAN AND Angloamerican STUDIES PHD”. শিক্ষকতার পাশাপাশি উনি সমান্তারালভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা যার নাম 7 LUNE এবং তার লিখালিখি।
২০০২ সালে তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হয় যার নাম “la carne del tiempo”. 2007 সালে তিনি পুরস্কার পান আর্জেন্টিনা থেকে IBISKOS থেকে তার লেখা বই স্পেনিস ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
2006 MET VENEZIA ,পুরষ্কার।
২০০৮ “parole d’acqua”, 2011 “jardin Ardiente” ,2014 “sacrobosco” 2016 “quiereo tanto a julio” 2018 “Malpaso ediciones” 2019 MESSICO “ E vissero infelici e contente 2020 “la notte dei corpi” 2020 premio speciale torino. কবিতার বই, উপন্যাস লিখেছেন এই গুনি লেখিকা।আমেরিকা,আর্জেন্টিনা, ইতালি থেকে জিতে নিয়েছেন অসংখ্য তার লিখা কবিতা এবং গল্প।
আমি জানতে চাইলাম কেন তিনি বাংলা ভাষায় কবিতা লিখলেন পৃথিবীতে আর অনেক ভাষা রয়েছে তবে কেন বাংলাকে বেছে নিলেন?
উত্তরে আমাকে সিভিয়া আমাকে জানায়>
সিল্ভিয়া যে স্কুলে শিক্ষকতা করে সেখানে কিছু বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী রয়েছে। যাদের কাছ থেকে ২১শের আন্দোলন এর কথা শুনেছিলন। সেখান থেকেই তার আগ্রহ জাগ্রত হয় বাংলা ভাষার প্রতি।ইন্টারনেট এর কল্যাণে ভাষা এবং ৭১ নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞানলাভ করেন।সিল্ভিয়া আমাকে বলেছিল যে দেশে ভাষার জন্য প্রান দিয়েছেন সেই ভাষার প্রতি আমার সন্মান জন্ম হয়েছে সেই সন্মানের জায়গা থেকেই আমার লিখা কিছু কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছি।
সিল্ভিয়ার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়েছে বহুবার। একজন ইতালীয় নাগরিক> তার যতটুকুন বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সন্মান রয়েছে।
তার যৎসামান্য যদি আমরা আমাদের মননে লালন করি তাহলে আর পরাধীনতার কবলে হারাতে হবেনা কোনোদিন আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ।
আজকাল অনেক অভিভাবকদের মুখে শুনা যায় আমার ছেলেমেয়রা আসলে বাংলা ভাষা ভালো করে জানেনা সন্তান দের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে। ইংলিশ বাংলিশ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি পাকায় তা থেকে আসলে কিছুই বোঝার উপায় থাকেনা।
অনেক শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য রাজপথে আন্দোলন হয়। পাকিস্তানি সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণদান করে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বার আরও কত নাম না-জানা সেসব শহীদের আত্মত্যাগে আমরা ফিরে পাই আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা।
জাতিসংঘের স্বীকৃতির ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস! ২১শে ফেব্রুয়ারি আসলেই ভাষার উপর অযাচিত ভালোবাসা বেড়ে যায়! শহীদ মিনারে ফুল দেয়া , সকালে প্রভাত ফেরী, ২১শের গান গাওয়া আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি ?
ফেসবুক, সোস্যাল মিডিয়া, রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার করা হয় ২১শে ফেব্রুয়ারির শোক প্রকাশ
!একুশের মাস শেষ হয়ে গেলেই আমরা ভুলে যাই সব কিছু। ভাষার জন্য ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কি শুধুমাত্র ১টি দিন নির্ধারণ করা উচিত? যে ভাষার জন্য যুদ্ধ করে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের প্রাপ্য কি শুধুমাত্র ১দিনের শোক প্রকাশ? আমাদের প্রফাইল পিকচার্স পরিবর্তন করে কি ভাষার প্রতি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা যায়?
আমাদের দেশে বেশিরভাগ অভিভাবকদের ধারনা তাদের ছেলে মেয়েরা যদি এফ্লুয়েন্ট ইংরেজী না জানলে তাহলে তাদের জাত যাবে। ইংরেজী তে কথা বলতে না পারলে ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত অন্ধকার। ভালো সরকারি, বেসরকারি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে পারবে না । পারলে জন্মের পরদিনই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেন । তা না পারলেও টেলিভিশন চ্যানেল গুলিতে ইংলিশ কার্টুন ছেড়ে রাখেন যাতে বাচ্চাদের মগজের কোষে ইংরেজী ঢুকে পড়ে! ইংরেজদের দ্বারা এত অত্যাচারিত হয়েও ইংরেজী ভাষার প্রতি কত দরদ আহা,,,,!
শুধু তাই নয় প্রবাসে যেসব বাবাঙ্গালী রা আছেন তারাও যে যে দেশে থাকেন সে দেশের ভাষায় সন্তানদের শেখান! ইতালিতে অনেক মায়েদের কাছে শুনি আমাদের ছেলে মেয়েরা তো বাংলা ভাষা জানে না! যে দেশে থাকি সে দেশের ভাষায় সন্তানদের শেখানোতে ভুল নেই,তবে তা নিজের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয় কিংবা অসম্মান করে নয়।
একথা ভুলে গেলে চলবে না শেকড় বাদ দিয়ে কখনো শেখরের সন্ধান মিলে না! জাতিসংঘের স্বীকৃতির ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ার পর ও আমাদের ভাষার প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই।
ভাষার জন্য যুদ্ধ করে প্রান উৎসর্গ করার ঘটনা বিশ্বে বিরল ঘটনা । আসুন কেবল ২১ শের দিনে নয় ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই প্রতিদিন । বাংলিশ না ,বাংলা ইতালিশ, না বাংলা ফ্রেন্স এর মিশ্রণ না ঘটিয়ে স্বচ্ছ বাংলা বলি তাঁতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে ।
বাংলিশ ইংলিশের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নিজেদের স্মার্টনেস প্রকাশ করা যায় না । বিভিন্ন দেশের ভাষা রপ্ত করা খুব ই ভালো কথা । তাতে করে জ্ঞান ভান্ডারের সমৃদ্ধি বাড়বে । কিন্তু ভাষার সংমিশ্রণ করে জগাখিচুড়ি বানানো ছাড়া আর কিছুই হয় না ।
ইতালিতে কাফসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার কোর্স চালু হয়েছিল একবার তা দেখে গর্বিত অনুভূতি হয়েছিল! মা নামে একটি শিক্ষামূলক এবং সৃষ্টিশীল বাংলা ভাষার বই লিখা হয়েছিল । আজ কয়েক বছর যাবত আর দেখা যাচ্ছে না আর কোনো বাংলা ভাষার কোর্স ।
এখানে যারা জন্ম গ্রহণ করেছেন পড়াশোনা করেছেন তাদের বাংলা ভাষা জানতে হবে, শিখতে হবে তাহলে সিল্ভিয়া র মত গুণী লেখকরা তাদের লিখা গল্প কবিতা একদিন বাংলা ভাষায় লিখবে। একদিন তাদের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে বিদেশে বিভুঁয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষার কোনো ইনস্টিটিউট, এবং গবেষণা কেন্দ্র ।
তাহমিনা ইয়াসমিন শশী
প্রবাসী লেখক ভেনিস,ইতালি tahmina.yasmin88@gamil.com
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |