- প্রচ্ছদ
-
- বাংলাদেশ
- ইটভাটা, মাটি ক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ
ইটভাটা, মাটি ক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ
প্রকাশ: ৯ এপ্রিল, ২০২১ ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ভূঁইয়া শাহাদাত:- মাটি মহান আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি মানুষের প্রাথমিক ও প্রধান সম্পদও বটে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে মানুষ মাটিকে শাসন করতে হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষের কয়েক ইঞ্চি জায়গা তৈরি করতে হাজার হাজার বছর সময় লেগেছে। একদা প্রকৃতি যেভাবে নিজেকে মেলে ধরেছিল মানুষের লোভ-লালসা আর অবহেলার শিকার হয়ে তা আজ ধ্বংসের পথে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশও এক সময় আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ধন-সম্পদ ও বন-বৃক্ষে ভরপুর ছিল। কিন্তু আজ সেসব কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। মুনাফাখোরি কাঠ ব্যবসায়ীদের লোভের বশবর্তী তা বিরান হয়ে যাচ্ছে। এসব বন সংরক্ষণের তাগিদ এসেছে অনেক দেরিতে, পঞ্চাশ থেকে একশ বছর পর।
কাল থেকে কালান্তরে মাটি অনেক ক্ষয় হয়েছে। প্রাচীন অনেক সভ্যতা মাটির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মাটি সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার পরই কেবল আমাদের মাঝে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার ইচ্ছা জেগেছে। জমি খণ্ডিতকরণের বিষয়টি অনেকটা বন উজাড়ের মতোই। এটা স্বীকৃত যে, আমরা আমাদের নগর এলাকার জমি এমন নির্দয়ভাবে টুকরো টুকরো করছি যে, তা ইতোমধ্যে এক অসুস্থ পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। জনসংখ্যা যত বাড়ছে আমাদের নগরীগুলোর আকৃতি ততই কমে যাচ্ছে। আর সব ক্ষেত্রে জমির জন্য এক বাড়তি প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন আকৃতিতে জমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। জমি কেনাবেচা স্টক/বন্ড কেনাবেচার মতো লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
কাদামাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির কারখানা তৈরি করা হচ্ছে। মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির কারখানাকে ইটভাটা বলা হয়ে থাকে। আধুনিককালে নয়, সুপ্রাচীনকালে নির্মাণকাজে ইটের ব্যবহারের কথা শুনতে পাওয়া যায়। খ্রিস্ট-পূর্ব চার শতকে নির্মিত নগরী পুণ্ড্রবর্ধন বা মহাস্থানগড়ের বিভিন্ন নির্মাণকাজে পোড়ানো ইট এবং কাদামাটির তৈরি রোদে শুকানো ইট ব্যবহৃত হতো। সে সময়ে ইট জোড়া দেয়ার কাজে চুন এবং চিটাগুড়ের মিশ্রণ ব্যবহৃত হতো। এ প্রযুক্তি শত শত বছর ধরে ইটের তৈরি স্থাপানাগুলোকে অনড় করে রাখতো। আধুনিক প্রযুক্তিতে এটি আরো উন্নত হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৬ হাজার ইট তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে। দেশে বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ইট তৈরি হয় বলে ধারণা করা হয়। অধিকাংশ ইটভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চালু থাকে। বছরের অন্য সময়ে ইটভাটা চলে না। এটিকে ঢাল সিজন বলে। শহরে, উপশহরে, বড় বড় কলকারখানা বা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি জায়গায় এবং যেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ও সহজে ইট আনা-নেয়া করা যায় এবং ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে ইটভাটাগুলো সাধারণত সে এলাকাতেই গড়ে উঠতে দেখা যায়। ইটভাটায় ব্যবহৃত কাদামাটি সচরাচর সংলগ্ন মাঠ থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে কিন্তু উপযুক্ত মাটি দূরবর্তী স্থান থেকেও সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এই কাদামাটি দেশের কৃষিকাজের উপযুক্ত মাটি। ভাটার মালিকরা নানা অজুহাতে গবির কৃষকদের বুঝিয়ে সামান্য টাকা-পয়সা দিয়ে মাটি সংগ্রহ করে থাকে। মাটি কেটে আনলে মাটির উপরিভাগের উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ইটভাটার ইট সাধারণত জ্বালানি কাঠ, কয়লা দিয়ে পোড়ানো হয়। কয়লার বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কাঠের গুড়া, ফার্নেস অয়েল এমনকি গাড়ির বাতিল টায়ারও ইটভাটায় ইটপোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন এবং ব্যাপকভাবে ইটভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ইটভাটার কারণে শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়। মূলত নিচু মানের জ্বালানি ও অনুপযুক্ত চিমনি ব্যবহারের কারণে ইটভাটাগুলো পরিবেশ দূষণে সহায়ক করছে। ইটভাটার চারপাশ ছড়িয়ে পড়ছে ছাই, ধুলা ও সালফার-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস। আক্রান্ত এলাকায় এসিড বৃষ্টির মতো ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ ছাড়া ইটভাটাগুলো শস্যাহানি, ধাতব পদার্থে মরচে সৃষ্টি, বর্ণক্ষয়, ভূমিক্ষয়, ভূমিধস ও ভূমির উর্বরতা হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ইটভাটায় ব্যবহৃত জায়গাজমি দীর্ঘ সময় কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জমির উর্বরতাশক্তি এমনভাবে নষ্ট হয় যাতে আর কোনো ফসল হয় না এবং এই জমিতে ফসল ফলালেও ফসল সামান্য উৎপন্ন হলে ফলাফল ভালো হয় না এবং এই জমিগুলোতে উর্বরতাশক্তি আনয়ন করতে দীর্ঘকাল সময়ের প্রয়োজন হয়।
মাটির উপরিভাগে খাদ্যের জন্য চাষাবাদ আর গভীর থেকে খনিজসম্পদ আহরণ সভ্যতার পরিক্রমায় মাটির এই ভূমিকার ধারণা পাল্টে গেছে। এখন মাটি শুধুই পণ্য উৎপাদনের উপায় নয়। মাটি এখন নিজেই ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হয়েছে। পণ্য হিসেবে নগর এলাকায় জমির ব্যবসা মাটির সনাতন ব্যবহারের চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক। বিপুল পরিমাণ মাটি সংগ্রহ করতে ভাটার মালিকরা সাধারণ কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বিনা পয়সায় কৃষিজমিতে পুকুর খনন করার লোভ দেখিয়ে মাটি কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিজমির মাটি উজাড় করছে। গরিব, অশিক্ষিত কৃষকদের সামান্য কিছু নগদ টাকা প্রদান করে লুফে নিচ্ছে কৃষকদের আবাদি জমি। ফলে কৃষি জমির ঘাটতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাটি ঘাটতির কারণে এভাবেই ফসলের জমি অকেজো গর্তে পরিণত হচ্ছে। কেবল সমতল ভূমি নয়, কোথাও কোথাও পাহাড় পর্যন্ত কাটা হয় ইটভাটার মাটি জোগাড় করার জন্য। বন-জঙ্গল উজাড়, কৃষির ক্ষতি ও দেশের ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে মাটি পুড়িয়ে তৈরা করা হচ্ছে ইট। ইট তৈরির জন্য এমনকি কাঁচা মাটিও বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ একক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার একক। ১৯৯৭ সালে এসে কমে এসে তা ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার একরে এবং সর্বোপরি ২০১২ সালে বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫৪ হাজার একরে।
প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়তির কারণে বাড়তি আবাসন, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে ভূমির ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। এতে করে আবাদি জমির দিন দিন কমতে শুরু করছে এবং এভাবে চলতে থাকলে কোনো সময় দেশের আবাদি জমির পরিমাণ শূন্যের কোটায় এসে দাঁড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু আবাদি জমি নয় একশ্রেণির টাউট-বাটপার, প্রতারক শ্রেণি আবাদি জমির পাশাপাশি দেশের মাটির সম্পদ বালুও বিক্রি করছে অবাধে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ মাটি আবাদি জমি থেকে সরাসরি উত্তোলিত করে বিদেশে পাচারও করা হচ্ছে। ফলে দেশের পরিবেশ ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যার ফল হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এতে করে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টনের্ডোর মতো আরো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলায় আমাদের পড়তে হবে। ফলে আমাদের ভোগ করতে অবর্ণনীয় কষ্ট।
ইটভাটায় প্রতি বছর প্রচুর ইট তৈরি করা হয়। এতে মাটিরও প্রয়োজন হয় প্রচুর। ইট পোড়ানোর জন্য প্রচুর কাঠ, কয়লার প্রয়োজন। ইট পোড়ার ফলে প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এই ধোঁয়া পরিবেশেরই ওপরও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হয়। একটি ইটভাটা তৈরির জন্য আয়তন ভেদে ৩ থেকে ৬ একক কৃষিজমির দরকার হয়। ভাটা বন্ধ হওয়ার পরও এই জমিতে দীর্ঘদিন তেমন কোনো ফসল উৎপাদন হয় না। কারণ মাটিতে ইটের টুকরো ও বালুর পরিমাণ বেড়ে যায়। মাটির উর্বরতা কমে যায়। মাটির ওপরের স্তরের মাটি এমনকি পুরো জমির ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি মাটি তুলে ফেলতে হতে পারে। তাতে উর্বরতা কিছুটা ফিরে এলেও জমি অনেকটা নিচু হয়ে যায়। কিন্তু এত কিছুর পরও প্রতি বছর সামান্য লোভে পড়ে জমির মালিকরা ভাটা মালিকদের মিথ্যে প্রলোভনে একক জমিকে ফেলে দিচ্ছে ধ্বংসের মুখে। সরকারি নীতিমালায় প্রতিটি ইটভাটায় ৬ একর জমি ব্যবহারের কথা বলা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ ৩৬ একরের অধিক পরিমাণ আবাদযোগ্য জমি ব্যবহার করছে। ইটভাটাগুলোয় এই পরিমাণ কৃষিজমি ব্যবহার করার কারণে প্রতি মৌসুমে কয়েক লাখ একর জমি নষ্ট হচ্ছে। এগুলো যেন দেখার কেউ নেই।
ইটভাটায় কর্মরত ও মাঠপর্যায়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, এক কোটি ইট তৈরি করতে কমপক্ষে আধ লাখ টন মাটির প্রয়োজন হয়। এ মাটির পুরোটাই আসে উর্বরা ফসলি জমির উপরিভাগ বা টপসয়েল থেকে। আর একটি জমির উর্বরাশক্তি বা টপসয়েল তৈরি হতে সময় লাগে শত শত বছর। ইটভাটার কারণে যে কেবল এমন মূল্যবান কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে তা নয়, ইট পোড়ানোর কারণে গাছ কাটা হচ্ছে, বনজঙ্গল উজাড় হচ্ছে। যদিও ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে ইটভাটাগুলোতে জ্বালানি হিসেবে প্রধানত কাঠই ব্যবহার করা হয়। এর ফলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। ইটভাটার ধোঁয়া সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে ইটভাটা তৈরির ফলে এমনিতেই দেশের পরিবেশে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ছে। তার ওপর রপ্তানির জন্য অতিরিক্ত ইট বানাতে গিয়ে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে বাংলাদেশের পরিবেশকে।
মাটি আমাদের অমূল্য সম্পদ। বিশ্বে যে কোনো দেশে ভূমিক্ষয় একটি মারাত্মক সমস্যা। প্রতিটি দেশ চেষ্টা করে যাতে তার দেশের ভূমিক্ষয় না হয়। ইদানীং শোনা যায়, আমাদের দেশ থেকে বাইরের দেশে মাটি ও ইট পাচার হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটি দিক। এতে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, গাছপালা কমে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাটির নিচে থাকা অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। ইট বানানোর জন্য কাঠ পোড়ানো কিংবা মাটি না থাকায় গাছ কমে যাওয়ায় পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাবে; যা আমাদের দেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যৎ ডেকে আনতে পারে। যে করেই হোক, যেমন করেই হোক মাটি পাচার, ইট পাচার রোধ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আবাসিক এলাকা থেকে ইটভাটা নির্মূল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এর ফল আমাদেরই ভোগ করতে হবে।
লেখক-
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ভূঁইয়া শাহাদাত
প্রেসিডেন্ট
লাইটহাউজ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
Please follow and like us:
20 20