উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে:-নড়াইলের ইতনা গনহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৩ মে ভোরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ইতনা গ্রামে একের পর এক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশুসহ হত্যা করে সৈয়দ শওকত, কওসার, মোশারফ হোসেন, হিরু মাস্টার, সফিউদ্দিন মোল্যা, তবি শেখ, হাদি সিকদার, নালু খানসহ ৩৯ জন গ্রামবাসীকে।
মুক্তিযুদ্ধে এমন বিভৎস ঘটনা ঘটলেও শহীদদের স্মরণে স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সেখানকার গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। সেখানে সরকারি উদ্যোগে কোনও স্মৃতিস্তম্ভও গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের দিন কাটছে চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে।
লোহাগড়া উপজেলার ইতনাসহ আশেপাশের গ্রামের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে লোহাগড়া উপজেলার মধুমতি নদী তীরবর্তী ইতনা ও কাশিয়ানী উপজেলার চরভাটপাড়া পাশাপাশি দুই গ্রাম। এই দুই গ্রামে বসেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের নানা পরিকল্পনা করতো। ভৌগলিক ও কৌশলগত কারণে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এই দুই গ্রামে অবস্থান করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতেন।
তিনি আরও জানান, পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে পেরে ১৯৭১ সালের ২২ মে দুপুরে চরভাট পাড়া গ্রামে প্রবেশ করে নিরীহ মানুষজনের ওপর হামলা-নির্যাতন শুরু করে। এ সময়ে মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় যুদ্ধ। প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে চারজন পাকিস্তানি সেনা ও ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটার সময় চরভাট পাড়া গ্রামের অনিল কাপালি নামে একজন সাহসী ব্যক্তি এক পাকিস্তানি সেনার কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে পাশের মধুমতি নদীতে ফেলে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
এ ঘটনার পর ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হিংস্র রুপ ধারণ করে। তারা চরভাটপাড়া গ্রামের অনিল কাপালিকে খুঁজতে থাকে। তখন প্রাণের ভয়ে চরভাট পাড়ার মানুষজন জানিয়ে দেয়, অনিল কাপালির বাড়ি মধুমতি নদীর পূর্ব পাড়ের ইতনা গ্রামে।
অনিল কাপালিকে ধরার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী গানবোটে এসে ৭১ সালের ২৩ মে ভোরে ফজরের আজানের সময় ইতনা গ্রামে ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যা চালায়। গণহত্যায় শিশুসহ ৩৯ জন নারী-পুরুষ হত্যার শিকার হন। সে সময় নিহতদের কবর দেওয়ার মত কোন লোক ইতনা গ্রামে ছিল না। পরবর্তীতে নিহতদের নিকট আত্বীয়-স্বজনেরা ৩৯ জনকে গ্রামেই যার যার মত করে কবর দিয়ে প্রাণ ভয়ে অন্যত্র পালিয়ে যান।
এদিকে সংরক্ষণ না করার কারণে গণকবরগুলির আজ তেমন কোনও অস্তিত্ব নেই। অপরদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এ ৩৯ জন শহীদকে ‘শহীদের তালিকায়’ অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। পাশাপাশি অভাব-অনটনে শহীদ পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না ৭১’র সালের ২৩ মে ইতনা গণহত্যার ইতিহাস। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানার জন্য ১৯৯৪ সালের ২৩ মে বীর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ইতনা গণগ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক আতাউর রহমান ফিরোজের উদ্যোগে ইতনা গ্রামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়কের পাশে গণহত্যায় নিহতদের নামের তালিকা স্মৃতিসৌধাকারে নামের তালিকা স্থাপন করা হয়েছে। সেই থেকে প্রতি বছর ২৩ মে ইতনা গণগ্রন্থাগারের উদ্যোগে ইতনা গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে। গণহত্যায় নিহতদের স্বরণে আজ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনও স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি।
ইতনা গণগ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক আতাউর রহমান ফিরোজসহ ইতনা গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ ইতনা গ্রামে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে সরকারি উদ্যোগে স্মৃতিফলক নির্মাণসহ ২৩ মে ইতনা গণহত্যার ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
গনহত্যা দিবস উপলক্ষে আজ ইতনায় স্মৃতিফলক সম্মুখে মানব বন্ধন ও ইতনা হাইস্কুল মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।