আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১১:১১
কামরুল হাসান, ঢাকা:- হাতে কোনো কাজ নেই। চিফ রিপোর্টার বারবার তাগাদা দিচ্ছেন কিছু একটা করে দেওয়ার জন্য। কী করব ভাবছি আর বন্ধু-সহকর্মীদের ফোন করছি। ফোন দিলাম প্রথম আলোর অপরাধ বিভাগের রিপোর্টিং প্রধান বন্ধু পারভেজ খানকে। পারভেজ তখন খাবার নিয়ে ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই।
পাশে ছিলেন অপরাধ বিভাগের প্রতিবেদক শহীদুল ইসলাম, তিনি ফোনটা ধরিয়ে দিলেন। পারভেজ খেতে খেতে বললেন, “ঢাকায় অপরাধ জগতের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন আর লিয়াকত আলাদা আলাদা জোট করেছে। লিয়াকতের সঙ্গে পাঁচজন আর সুব্রত বাইনের দলে আছে সাতজন। সুব্রতরা নিজেদের ‘সেভেন স্টার’ আর লিয়াকতেরা ‘ফাইভ স্টার’ বলছে। একটু খোঁজ করে দেখ, কিছু করা যায় কি না।”
ফোন দিলাম ঢাকার অপরাধজগৎ সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন এমন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে। কেউ কিছু বলতে পারলেন না। শুধু ডিবির এসি আখতারুজ্জামান রুনু বললেন, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, জয়, টিক্কা, চঞ্চলসহ ছয়-সাতজন মিলে ইদানীং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। সড়ক ও জনপথের আড়াই শ কোটি টাকার টেন্ডার ভাগাভাগিতে তাদের সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। জোট করার খবর সত্যি হলেও হতে পারে।
সামনে বসা চিফ রিপোর্টার চশমার নিচ দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছেন। অগত্যা হালকা চালে একটি নিউজ করে দিলাম—ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন জোট ‘সেভেন স্টার’। সাংবাদিকতায় যাকে বলে ‘টেবিল মেড’ স্টোরি। ছাপা হলো। পরদিন পুলিশ দুই ছিঁচকে ধরে প্রেসরিলিজ দিয়ে বলল, সেভেন স্টার বাহিনীর দুই সন্ত্রাসী ঢাকায় গ্রেপ্তার। পুলিশের কাণ্ড দেখে ক্রাইম রিপোর্টাররা হেসে কুটিকুটি।
এই যে কথিত সেভেন স্টার বাহিনী, তারই প্রধান ছিলেন সুব্রত বাইন। পুলিশের খাতায় পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। বহুদিন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপিয়ে এখন ভারতের কারাগারে বন্দী। আজ ‘আষাঢ়ে নয়’, এটা সেই ভয়ংকর সন্ত্রাসীর গল্প।
সুব্রত বাইনকে জীবনে একবারই দেখেছি, তাও আলো-আঁধারিতে। আমাদের যৌবনে চাইনিজ খাওয়া ছিল খুব বড় একটা ব্যাপার। তো একবার এক বন্ধুর সঙ্গে অনেক রাতে গেলাম মগবাজারের চাংপাই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। তৃতীয় তলায় উঠে দেখি সব ফাঁকা, শুধু পাঁচ-ছয়জন একটা টেবিলে বসে কথা বলছেন। আমরাও বসলাম একটা টেবিলে। কিন্তু ওয়েটার আমাদের সেখানে বসতে দেবে না। কারণ কী? জানতে চাইলে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, সুব্রত বাইন দলবল নিয়ে মিটিং করছে। এরপর সুব্রত বাইন বলে যাকে সে চিনিয়ে দিল, সেই পাতলা লম্বা লোকটা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কাকে যেন গালিগালাজ করছে। দোতলায় এসে খেলাম বটে, পরদিন ঠিকই জনকণ্ঠে ছাপা হলো, ‘চাইনিজ রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসীর গোপন বৈঠক’। ব্যস, ডিবি হানা দিল।
সেই খবরের তথ্য জোগাড় করতে গিয়ে জানলাম, সুব্রত বাইনের আদিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে। তার বাবা বিপুল বাইন ছিলেন একটি এনজিওর গাড়িচালক। মা কুমুলিনি আর তিন বোন মেরি, চেরি ও পরীকে নিয়ে ঢাকার মগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতেন। সুব্রত বাইন বড় সন্তান। ১৯৬৭ সালে জন্ম, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে।
বরিশালে অক্সফোর্ড মিশন স্কুল নামে খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুল আছে। সুব্রত বাইনকে ছোটবেলায় সেই স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখানে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। সেখানে ভালো না করায় তাঁকে ঢাকায় শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এসএসসি। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সেখানকার এক নেতার সঙ্গে পরিচয়। কলেজে ভর্তি হওয়া আর হয়নি তাঁর। তখন থেকে বইয়ের বদলে হাতে ওঠে অস্ত্র।
খুব অল্প দিনেই মগবাজারে একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে ওঠে সুব্রতর নেতৃত্বে। ’৯৩ সালের দিকে মধুবাজার বাজারে সবজিবিক্রেতা খুন হলে পুলিশের তালিকায় তাঁর নাম ওঠে। এর কিছুদিন পর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলি হয়। এর পরই সুব্রত বাইনের নাম গণমাধ্যমে চলে আসে। সুব্রত বাইন পরে বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতাও হন। সেই পরিচয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেন।
’৯১-এর নির্বাচনে তিনি বিএনপির হয়ে মগবাজার এলাকায় কাজ করেন। এতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খুব কাছের লোক হয়ে যান। মগবাজারের মধুবাগ মাঠে একবার তাঁর জন্মদিনের উৎসবও হয়। ওই উৎসবে বিএনপির অনেক নেতা হাজির হওয়ার পর সুব্রত বাইন রাতারাতি তারকা সন্ত্রাসী বনে যান।
সে সময় যুবলীগের লিয়াকত মগবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। লিয়াকতের কবল থেকে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বিএনপিপন্থীরা সুব্রতকে সমর্থন দেন। এরপর ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডারে নেতৃত্ব দেন সুব্রত। এ ছাড়া মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ বেশ কয়েকজন তাঁর হাতে খুন হন। ওই সময় রমনা, মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও মধুবাগ এলাকায় গোলাগুলি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। অবস্থা এমন হয়েছিল যে হতাহতের খবর না পেলে পুলিশও ঘটনাস্থলে যেত না। এভাবে খুব অল্প সময়ে রাজধানীর দক্ষিণাংশের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে সুব্রত বাইনের হাতে। তাঁর বিরুদ্ধে সে সময় কমপক্ষে ৩০টি মামলা ছিল। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে আগারগাঁওয়ে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মুরাদ খুনের ঘটনায় তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হয়।
১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন গ্রেপ্তার করেন সুব্রত বাইনকে। বছর দেড়েক জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে যান। সুব্রত জেলে থাকার সময় তাঁর স্ত্রী লুসি গ্রুপের এক যুবকের প্রেমে পড়েন। জেল থেকে বেরিয়ে ঘটনা জানার পর সুব্রত নিজেই লুসিকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। লুসির দুই সন্তান ছিল। পরে ১৯৯৯ সালে কুমিল্লায় বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করেন সুব্রত। তবে বিয়ের কয়েক বছর পর বিউটিকে ডিভোর্স দেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এবং তাঁদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। এ তালিকায় প্রথম নামই ছিল সুব্রত বাইনের। তাঁর নামে ইন্টারপোলেও নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর সুব্রত ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়েন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জামেলা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই ঘরে একটি মেয়ে আছে।
ভারতে গিয়ে সেখানে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করেন সুব্রত। সুব্রতর ছোট বোন চেরির স্বামী অতুল জানিয়েছেন, ‘সুব্রতর ভারতীয় নাগরিকত্বের সব কাগজপত্র আছে। তার পরও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা পুলিশ তাঁকে আটক করে। তবে বেশি দিন জেলে থাকতে হয়নি। জামিন পেয়ে দুবাই চলে যান। সেখান থেকে ফিরে কলকাতার এক চিত্রনায়িকার কাছে মোটা টাকা চাঁদা দাবি করেন। সেই ফোনের সূত্র ধরে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স তাঁকে ধাওয়া করে।
টাস্কফোর্সের তাড়া খেয়ে সুব্রত নেপালের সীমান্ত শহর কাঁকরভিটায় ঢুকে পড়েন এবং নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। প্রথমে তাঁকে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর এবং পরে ঝুমকা কারাগারে নেওয়া হয়। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সেই কারাগারে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে পালিয়ে যান। আবার কলকাতায় আসার কয়েক দিন পর ২৭ নভেম্বর বউবাজার এলাকা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে তিনি কলকাতার জেলেই আছেন।
কলকাতায় থাকার সময় সেখানে বসেই ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন সুব্রত বাইন। সড়ক ও জনপথের বড় বড় ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি করতেন। সেই চাঁদার টাকায় নদীয়ায় ৫০ বিঘা জমিসহ এক বাগানবাড়ি কেনেন। এ ছাড়া ঢাকা ও কলকাতার ব্যবসায়ীদের টাকা আদায়ের কাজটি তিনি করতেন। কলকাতার ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা ঢাকার কোনো ব্যবসায়ীর কাছে আটকে গেলে সুব্রতর লোকজন আদায় করে দিত।
চাঁদার টাকা গাজীপুরে বসবাস করা মা-বাবার কাছেও পাঠাতেন সুব্রত। পুবাইলের হারবাইদ নয়াপাড়া এলাকায় পাঁচ কাঠা জায়গা কিনে একতলা বাড়ি তৈরি করেন। সেই বাড়িতে এখন তাঁর মা-বাবা থাকেন। সুব্রত বাইন ছাড়াও বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের নিয়ে প্রথম আলোয় একটি রিপোর্ট করেছিলাম ২০০৬ সালের ১৪ মে। ‘দেশের টাকায় বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের বিলাসী জীবন’ শিরোনামের সেই রিপোর্টে আমার সঙ্গে ছিলেন বাণিজ্য বিভাগের তখনকার প্রধান শওকত হোসেন মাসুম। ছাপা হওয়ার দিন প্রথম ফোন করেন শাহাদত পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি। তিনি ফোন করে বকাঝকা করেন। বিকেলের দিকে ফোন করা ব্যক্তি নিজেকে সুব্রত বাইন পরিচয় দেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের হাতে কলম আছে বলেই যা খুশি তাই লিখে যাচ্ছেন। সত্য–মিথ্যা মিলিয়ে আমাকে নিয়ে যা লিখেছেন, সেটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চেয়ে কোনো অংশেই কম না। নিজের বিবেকের কাছে একবার প্রশ্ন করেন, বুঝতে পারবেন সাংবাদিকতার নামে কী করছেন।’
লোকটি ফোন রেখে দেন। কিন্তু তাঁর কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আমার মনেও কিছুটা খটকা। বারবার মনে হচ্ছিল, ক্ষয়িষ্ণু সমাজের সংবাদকর্মী আমি, সাংবাদিকতার নামে, নিজের জীবিকার নামে মানুষের দুঃখ-দৈন্যকে পণ্য করছি না তো?সূত্র :আজকের পত্রিকা
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |