আজ রবিবার | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | সন্ধ্যা ৬:০৪
কানিজ ফাতেমা খুশী / মনির হোসেন জীবন: বর্ষার শেষ। শরৎ এর আকাশে ছেড়া ছেড়া মেঘ। নদীটি ইছামতি। ইছামতি নদীর পাড় ধরে ফোটা কিছু কাঁশফুল বাতাসে হালকা হালকা ছোঁয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। পাখির দল গাছ থেকে উড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি স্বয়ম্বরা। ঈশিতা, ঈশিতা, ও ঈশিতা! ঈশিতা রে! একদল বালিকা উঠোনে দাঁড়িয়ে যে যার মতো চিৎকার করে ডাকছে। আর সেই মুহূর্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন পুরুষ। বললেন, সে তো তার মায়ের সঙ্গে গোসলে গেছে। যাও, ইছামতির পাড়ে খোঁজ করো। ঠিক আছে চাচা, তাহলে যাই। এই চল চল। বলতে বলতে বালিকার দল বাদবাকি কথা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একজন কাপড় জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতেই অন্যরা হেঁসে উঠল। যে মেয়েটি পড়ে গিয়েছে, তার দুই চোখ ভরা টলটলে পানি! অন্যরা ততক্ষণে তাকে হাত ধরে টেনে তুলে জ্ঞান দিচ্ছে, বলছে, এই টুকু আছাড় খেয়ে পড়তেই কান্না করতে হবে? ফ্যাদ কাঁদুনে মেয়ে নাকি তুই? এভাবে হবে না। মনটাকে শক্ত করতে হয়। বড় হয়ে বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতে এরচেয়ে বড় বড় আছাড় খাবি। শাশুড়ি ননদ টেনেও তুলবে না। অমন ফ্যাদ কাঁদুনে কান্না কেউ শুনবে না রে সেতারা! ওঠ ওঠ, চল ঈশিতা গোসলে গেছে। আমরাও যাই। সেতারা কাপড় ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়িয়েছে। চোখের পানি মুছে নিয়েছে হাতের উল্টো পিঠে। কয়েক পা হাঁটলেই তো ইছামতি নদী! বর্ষার পানিতে এখনো ফুলেফেপে আছে। পুরোপুরিভাবে পানি কমে যায়নি। আবার সে হাড় কংকাল জরাজীর্ণ রূপ নেবে। বালিকার দল পথে যেতে যেতে করমচা, কাঁচা তেঁতুল, কুড়িয়ে নিয়েছে আঁচল ভরে। সেতারা সামান্য দুর্বল। সদ্য জ্বর থেকে উঠেছে সে। তাই সে হাঁটছে মন্থর গতিতে। সাথীরা তাড়া দিল তাকে, কী মেয়েরে তুই! কেঁচোর মতো যাচ্ছিস, একটু তাড়াতাড়ি হাঁটা দে। ইছামতির পাড়ে চলে এসেছে তারা। ঈশিতা তখন নদীর মাঝপথে, সাঁতার কাটছে মা মেয়ে মিলে মহা আনন্দে। ঈশিতা! ঈশিতা! এই ঈশিতা! ঈশিতা মাকে ফেলে সাঁতার কেটে এগিয়ে এলো দ্রুত পাড়ের দিকে। হাত নাড়ল সাথীদের দিকে। পানির মধ্যে থেকেই সেতারাকে দেখে মৃদু বকুনি দিয়ে সে বলল, কী রে সেতারা। তোর না শরীর খারাপ! জ্বরজ্বারি, করোনাভাইরাস নিয়ে নদীতে এলি! পাড়ে এসে উঠল ঈশিতা। সাথীদের বলল, দম শেষ। আহ্! এই যে সেতারা সুন্দরী! কতোদিন জ্বরে ভুগলি! চেহারা তো শুকিয়ে শুটকির মতো দেখাচ্ছে। তা তুই কি শরীর থেকে করোনা ধুয়ে ফেলতে নদীতে গোসল করতে এলি? সেতারা হাসল। বলল, না, করোনা হয়নি আমার, সাধারণ জ্বর ছিল। ঘরে শুয়ে শুয়ে ভালো লাগছিল না। তোকে দেখতে নদীতে চলে এলাম। সাথীদের একজন বলল, তোদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল! সে কী কান্না মেয়ের! ঈশিতা পানি থেকে উঠে গামছা বুকের উপর ভালো করে জড়িয়ে নিল। তারপর বলল, চল বাড়ি চল। ঈশিতাকে বড় মেনে চলে মেয়ের দল। তার কথাবার্তার মধ্যে যেন কী আছে! সকলের জন্য তার প্রাণে বড্ড মায়া, ভালোবাসা। হইচই করে ফিরতে থাকে মেয়ের দল। সঙ্গে মা। চলতে চলতেই একজন বলল, কি রে সেতারা তোর বিয়ে খবর বললি না ঈশিতাকে? বিয়ে! সেতারা তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! তার প্রাণাধিক প্রিয় সইয়ের বিয়ে পাকা আর সে জানে না! অবাক ঈশিতা। সেতারার চোখের বাঁধ ভেঙেছে। নিঃশব্দ কান্না। ঈশিতার হাত ধরে চলেছে সে দুর্বল পা ফেলে ফেলে। পেছন থেকে মা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় হল রে সেতারা? কবে ঠিক হল? বিয়ে কবে? কই, কিছু শুনলাম না তো! সেতারার মুখে কথা নেই। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে তার পিঠ-বুক। আনন্দের সকালটি যেন এক পলকে ভারাক্রান্ত। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, কবে হল পাকা কথা? জ্বরের মধ্যে। বর কেমন? দেখিনি তো। জানি না। মা বলল ভালো ঘর। বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলল সেতারা। মেয়ের দলের আর হাসি ধরে না যেন সেতারার কান্না দেখে। রুবী তার নাকের মাথা টিপে দিয়ে বলল, আহা! ঢং দেখো! বিয়েই তো হবে। বর কত সোহাগ করবে দেখিস! আমার ফুপাত বোনের বিয়ে হল না সেদিন? বোন বলছিল, বর নাকি খুব সোহাগ করে। হি হি। তবে নাকি খুব যন্ত্রণাও দেয় বলল। হি হি হি। বলছে আর হাসছে সে। রুবীর বলার ধরণ দেখে হেসেই ঢলে পড়ল মেয়েরা এ-ওর গায়ে। হা হা হি হি হাসিতে প্রায় দুপুর হতে যাওয়া সময় এখন মুখরিত। ঈশিতা গম্ভীর মুখে বলল, তোরা অনেক পাকামি করছিস রুবী! সেতারা কাঁদছে! বিয়েতে কোনো সমস্যা থাকতে পারে। বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে খোঁজ নিবি, তা না হেসে মজা নিচ্ছিস। রুবী হাসি থামিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, মৃদু ধমকের সুরে ঈশিতা থামিয়ে দিয়ে বলল, তোরা সবাই যা, আমি সেতারাকে নিয়ে পেছনে আসছি। সবাই চলে গেল। সেতারা বলল, আমি এখন বিয়ে করব না। যে করেই হোক বিয়ে ভাঙতে হবে। ঈশিতা মুখে হাসি এনে বলল, সেকথা বলতেই পারতি। এতো কান্নকাটির দরকার হয় না। গত বার যে কৌশলে তোর বিয়ে ভেঙেছি এরপর দেখবি কী উপায় খুঁজে বের করি। গত বছরে বিয়ে প্রায় হয়েই গিয়ে ছিল সেতারার। কথা পাকাপাকি হওয়ার পর থেকেই রাতদিন কেঁদেটেদে অস্থির। বাড়িতে কেউ শুনবে না তার কথা। কেউ বুঝতে চেষ্টাও করল না। এই অবুঝ বালিকার বিয়েতে অমত তা নিয়ে কারোর মাথা ব্যথা নেই। মেয়ে একটু বড় হলেই তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়ার পায়তারা। মেয়ের পছন্দ-অপছন্দের খোঁজ খবর নেওয়ার বাধ্য বাধকতা নেই। বিদেশ থেকে আসা যুবকের প্রস্তাব পেলেই মেয়ের পড়াশোনার উপর চিরকাল ফুলস্টপ লাগিয়ে দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া। পড়াশোনায় খুব ভালো সেতারা। সবসময়ই ক্লাসে ফার্স্ট হয়। লেখাপড়া করে ডাক্তার হবে, গ্রামে ক্লিনিক খুলে গরীবদের সেবা দেবে এতো বড় স্বপ্ন তার। গেল ফাল্গুনে মকবুল চাচার এগারো বছরের মেয়েটা টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। বুকফাটা কী আর্তনাদ মকবুল চাচার! একমাত্র মেয়ের জন্য কী করুণ শোক সয়ে সয়ে বুকে পাথর ধরেছেন, স্বজনহারা মানুষেরাই এই দুঃখ বোঝে। শেষমেশ পাগলই হয়ে গেলেন! সেই ঘটনার পর থেকে সেতারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে সে ডাক্তারি পড়বে, টাকার অভাবে গ্রামের আর কাউকে চিকিৎসাহীন মরতে দেবে না। তার এতদিনের যত্নে গড়া স্বপ্নকে সৌদি প্রবাসী এক বাঙালি যুবক এসে এক ধাক্কায় চুরমার করে দেবে! ভাবতেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গিয়েছিল। ঈশিতা তার স্বপ্নের পুরোটা জানতো। কেউ তাকে পরিপূর্ণ বুঝতে পারলে ঈশিতাই বুঝে। এ জন্য মাঝে মাঝে ঠাট্টার সুরে সেতারা বলত, ‘তুই ছেলে হলে তোকেই বিয়ে করতাম। এত আমার মন বুঝিস! তুই আমার মা, বাবা, ভাই বোনের চেয়েও বড়।’ সেই ঈশিতা রাতারাতির ভেতর বিয়ে ভেঙে দিল কৌশলে। তার ফুপাত ভাইয়ের সাহায্যে হবু বরের মোবাইল ফোন কলে গুন্ডা-মাস্তান টাইপ গলায় হুমকি ধামকি দিয়ে বিয়ে ভাঙল। সেতারা চোখ মুছে বলল, এবার কী করবি তুই? ঈশিতা দুই ঠোঁটের মাঝে আঙুল দিল। সাবধানতার গলায় বলল, একদম গোপন কথা। দুই কানে গেলেই অসুবিধা। এরপর গত বার বিয়ে ভাঙার স্মৃতি মনে পড়ে যেতেই দুজনে হি হি হি হেসে উঠে। পেছনে বহমান ইছামতী, দুজন বালিকার হাস্যোজ্জ্বল সুখের সঙ্গে ইছামতীরও যে সুখ তারা জানল না। যাও বালিকা যাও।
Dhaka, Bangladesh রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:16 AM |
Sunrise | 6:37 AM |
Zuhr | 11:57 AM |
Asr | 2:57 PM |
Magrib | 5:17 PM |
Isha | 6:38 PM |