আজ মঙ্গলবার | ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ |২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১০:৫৫
মনির হোসেন জীবন- একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আব্দুল মতিন (৭০)কে সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত যুদ্ধাপরাধী মোঃ আব্দুল মতিন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামের মৃত মিরজান আলীর পুত্র। দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দান করেন মতিন। গ্রেফতারকৃত মতিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল।
দীর্ঘ ৭ বছর যাবৎ পলাতক থাকার পর তার ভাগ্নের বাড়ি থেকে রোববার দিবাগত রাতে র্যাব-৩ এর একটি দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করতে সক্ষম হয়।
আজ সোমবার দুপুর ১২ টায় র্যাব-৩, টিকাটুলি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৩) এর কমান্ডিং অফিসার (অধিনায়ক) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ এসব তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার স্টাফ অফিসার (মিডিয়া) মোঃ আসাদুজ্জামানসহ র্যাবের অন্যান্য পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এসময় উপস্হিত ছিলেন।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি দল সোমবার দিবাগত রাতে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানা এলাকা থেকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী এবং যুদ্ধাপরাধী মোঃ আব্দুল মতিনকে আটক করতে সক্ষম হয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব বলছে, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫ টি অভিযোগ আনা হয়। আটক আব্দুল মতিন এবং ওই মামলার অপর আসামি তার আপন ভাই আব্দুল আজিজ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বারপুঞ্জিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তারা পালিয়ে বড়লেখায় এসে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। এছাড়া আব্দুল মতিন বড়লেখা থানা জামায়াত ইসলামী এবং ১৯৭১ সালে গঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘ এর সক্রিয় সদস্য ছিল। আব্দুল মতিনসহ রাজাকার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা মিলে মৌলভীবাজার এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড চালাত।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানান, ১৯৭১ সালে ১৯ মে তারিখে আটক আব্দুল মতিনসহ ওই মামলার অপর দুই আসামি আব্দুল আজিজ, আব্দুল মান্নান এবং তাদের সহযোগীরা মিলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানার ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাস, মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করে। তাদেরকে ৩ দিন যাবৎ বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন করার পরে জুড়ি বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে যায়। সেই বধ্যভূমিতে হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাস, মতিলাল দাস এবং নগেন্দ্র কুমার দাস এই ৩ জনকে হত্যা করা হয়। অপহরণকৃত শ্রীনিবাস দাস নির্যাতিত অবস্থায় কোনক্রমে পালিয়ে কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে যায়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে গ্রেফতারকৃত মতিন, মামলার অপর আসামি আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বড়লেখা থানার কেছরিগুল গ্রামের বাসিন্দা সাফিয়া খাতুন এবং আব্দুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখান রাজাকার ক্যাম্পে আসামিরা সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে। পরবর্তীতে তারা টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্প থেকে সাফিয়া খাতুনকে প্রথমে শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প এবং কিছুদিন পর বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানেও সাফিয়া খাতুনকে বারবার গণধর্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া খাতুনকে সিও অফিসের বাংকার থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে।
র্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর তারিখ আটক মতিনসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মিলে বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বসতবাড়িতে সশস্ত্র হামলা করে ব্যাপক লুটপাট চালায়। মুক্তিযোদ্ধা মঈনের পিতা বছির উদ্দিন, চাচা নেছার আলী, ভাই আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে কিছুদিন আটক রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে রাজাকার ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে গ্রেফতারকৃত মতিন, মামলার অপর আসামি আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বড়লেখা থানার হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাকিন কমান্ডারের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাকিন’কে তারা বাড়িতে না পেয়ে মুস্তাকিনের ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। তাদের অমানবিক নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙে যাওয়াসহ গুরুতর আহত হয়। পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মুস্তাকিন ও মতছিন আলীর বসতবাড়িতে লুটতরাজ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে কয়েকটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখ আটককৃত আসামি মতিন এবং অন্যান্যরা মিলে বড়লেখা থানার ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। তাকে সাথে করে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন্য তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। সেখান থেকে তারা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরে তারা মনির আলীর স্ত্রী আফিয়া বেগমকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে। বসতবাড়িতে হামলা চালানোর সময় হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর ঘরের যাবতীয় মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায় রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
র্যাব-৩ এর কমান্ডিং অফিসার সংবাদ সম্মেলনে জানান,আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর আটক আব্দুল মতিন, আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই এবং আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। পরবর্তীতে ওই তদন্তটি ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে শেষ হয় এবং তদন্ত চলাকালীন ২০১৬ ডালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ১ মার্চ তারিখ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই’কে গ্রেফতার করে এবং তারা বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে আটক রয়েছে। অপরদিকে, আটক আসামি আব্দুল মতিন তখন গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে গভীর তদন্তে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত ৫ টি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমানিত হলে ২০২২ সালের ১৯ মে তারিখ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক আব্দুল মতিন, আব্দুল আজিজ এবং আব্দুল মান্নান’কে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, আটক আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হওয়ার পরপরই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে সে পলাতক জীবন যাপন শুরু করে। সে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামের নিজ বাড়ি ছেড়ে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানা এলাকায় তার ভাগ্নের বাড়িতে আত্মগোপন করে।
তিনি আরো জানান, সেখানে সে নিজেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে পলাতক জীবন শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত মতিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। তার ভাগ্নের বাড়িতে দীর্ঘ ৭ বছর যাবৎ পলাতক থাকাকালীন অবস্হায় রোববার দিবাগত রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি দল তাকে আটক করতে সক্ষম হয়।
এদিকে, আজ সোমবার দুপুর সোয়া তিন টার দিকে র্যাব-৩ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার স্টাফ অফিসার (মিডিয়া) মোঃ আসাদুজ্জামান বাসসকে জানান, গ্রেফতারকৃত যুদ্বাপরাধী মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী মতিনকে জিঙ্গাসাবাদ শেষে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়েছে।
Dhaka, Bangladesh মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ | |
Salat | Time |
Fajr | 5:17 AM |
Sunrise | 6:38 AM |
Zuhr | 11:58 AM |
Asr | 2:58 PM |
Magrib | 5:18 PM |
Isha | 6:39 PM |